জুনায়েদ খান :
সচিবালয়ে গিয়েছিলাম একটা স্কলারশিপের আবেদনপত্র জমা দিতে। গিয়ে দেখি একই কাজে আরো অনেকেই এসেছেন।
মজার ব্যাপার হলো ২ নং গেটের যে বুথে আবেদনপত্র জমা নেয়ার কথা- গিয়ে দেখি সেই গেট, সেই বুথ সব তালাবদ্ধ! ১ নং গেট অবশ্য খোলা আছে। ১ নং গেটের সামনে যেতেই গার্ড, পুলিশ সব হৈ হৈ করে উঠলো- “এখানে দাঁড়ানো যাবে না, সরে যান, সরে যান!”
আসার উদ্দেশ্য বলাতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখিয়ে বললো, “ওনার সাথে কথা বলুন। উনি দায়িত্বে আছেন।”
উনি দেখামাত্র প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললো, “চলুন, রাস্তার ওপাড়ে চলুন।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ওপাড়ে যাবো কেন?”
উনি ফিসফিস করে বললেন, “নাস্তা পানি খাওয়ার জন্য কিছু দেবেন না?”
তাপমাত্রা ৩৪°সে। আর্দ্রতার কারণে তা ৪৪°সে ফিল হচ্ছে। মেজাজ এমনিতেই গরম ছিলো। গলায় উঁচিয়ে বললাম, “সরেন মিয়া! আপনারে টাকা দেব ক্যান?”
লোকটা মিনমিন করে বললো, “উপকার করবো আর টাকা দেবে না!”
আমি তড়িঘড়ি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম।
যোগাযোগের জন্য দেয়া +88029576679 নাম্বারে ফোন দিয়ে ঘটনা সবিস্তারে বললাম। টাকা দাবী করার ব্যাপারটা বললাম।
উনি বললেন, গেইটের পুলিশের সাথে কথা বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিপত্র যেখানে জমা নেয় সেখানে জমা দিতে।
পুলিশ যে জায়গা দেখিয়ে দিলো সেটি সেই বন্ধ থাকা বুথ! আবার ফোন দিলাম।
কয়েকবার ফোন বাজার পর ভদ্রলোক পিক করলেন। এবার কণ্ঠে অন্য সুর। বললেন, লকডাউন দেয়ায় বুথ বন্ধ। আমি যেন ডাকে পাঠিয়ে দেই।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, “এটা কোন ধরণের কথা? সরাসরি জমা দিতে বলে আবার ডাক কেন?
আপনারা বুথ বন্ধ রাখবেন সেটা জানিয়েছেন? দালাল দিয়ে তো ঠিকই জমা নিচ্ছেন। দেশের সচিবালয়ের সার্ভিস এমন হলে দেশ চলবে কি করে?”
উনি প্রতিবাদ করে বললেন, “দেখুন, বাইরের দালালরা আমাদের লোক নয়। আপনার পরিচিত কোন সচিব/উপসচিব/যুগ্মসচিব স্যার থাকলে তাকে বলেন, উনি আপনার ঢোকার ব্যবস্থা করলে আমি নিজে আপনার কাগজ গ্রহণ করবো। আমি রাস্তা দেখিয়ে দিলাম। ব্যবস্থা আপনি করেন।”
আমার ফোন দেয়া দেখে এক দালাল স্ব প্রনোদিত হয়ে ছুটে আসলো। “কয়টা আপনাদের?” আমরা পাত্তা দিলাম না জন্য সে রাগ করে চলে গেলো।
মেজাজ আরো খারাপ হলো। আমি ওয়েবসাইটে ঢুকে সচিবগণের নাম্বার খুঁজতে লাগলাম।
ওয়েবসাইট পার্শিয়ালি ডাউন। লিংকে ক্লিক করলে ইরোর কোড দেখায়। পুরনো প্রজ্ঞাপনে দেয়া নাম্বার থেকে একজন উপসচিবকে ফোন দিলাম। ওনার অফিসের কেউ একজন ধরলেন। আমার আসার উদ্দেশ্য ও দালালচক্রের কথা জানালাম।
উনি সব শুনে বললেন “আপনি যাকে ফোন করেছেন এটা তার নাম্বার না। আপনি সৈয়দ আলী রেজা স্যারের সাথে কথা বলুন।”
দালাল লোকটা আবার এলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “ফোনে কি বললো? ঘন্টার পর ঘন্টা খামোখা দাঁড়ায়া আছেন।”
আমাকে বাইপাস করে বাকিদের বললো, “আমি এখানকারই লোক। এই দেখেন আইডি কার্ড। সবগুলা খাম দেন আমি যাওয়ার সময় জমা দিয়া দেবো। ২০০ টাকা দিলেই হবে।”
লোকগুলো আমার মুখের দিকে চাইলো। আমি বললাম, “আমি দালালের হাতে জমা দেবো না ভাই!”
দালাল আবার বিরস মুখে চলে গেলো। আমি ওয়েবসাইটে আলী রেজা সাহেবের নাম্বার খুঁজতে থাকলাম। ওয়েবসাইট বরাবরের মতোই ডাউন।
গরমে দরদর করে ঘামছিলাম আর সচিবালয়ের সার্ভিসে যার পর নাই হতাশ হচ্ছিলাম। অবশেষে গুগলে ওনার নাম লিখে সার্চ দিলাম। কোন এক লিংক থেকে সরকারি নাম্বার পেলাম। মোবাইল বাজে, কিন্তু ধরেন না। ফোন নাম্বারে ফোন দিলাম। অনেক বিরতির পর এক ভদ্রমহিলা ধরলেন।
পরিচয় দিয়ে আসার কারণ, বুথ বন্ধ ও দালালদের টাকা দাবীর কথা বলে একরাশ ক্ষোভ ও বিরক্তি উগড়ে দিলাম। উনি সব শুনে হেসে বললেন, “ডুয়েট থেকে আপনার আসার কি দরকার ছিলো। মফিজ সাহেবকে বললেই তো ব্যবস্থা করে দিতেন।”
তারপর উনি বেশ আন্তরিকতা দেখিয়ে মোবাইল নাম্বার নিলেন, দালালদের হাতে জমা দিতে বারণ করলেন এবং একটু পরেই একজন স্টাফকে পাঠিয়ে দিলেন। আর শেষে বললেন, এটা আলী রেজা স্যারের নাম্বার না! আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম।
২ মিনিটের কাজ ১ ঘণ্টা ধরে সেরে ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরলাম।
দেশের হৃদপিণ্ডের অবস্থা যদি এমন হয়, তবে সেটা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। এসব নিয়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা কি ভাবার অবকাশ পান? দেশটা কি আদৌ সুস্থ হবে কখনো?
লেখকঃ জুনায়েদ খান, সহকারী অধ্যাপক, ডুয়েট, গাজীপুর।