আনোয়ার এমডি হোসেইন। অর্জিত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও অধ্যাবসায়ের গুণ গুণান্বিত এই বাংলাদেশি ছুটে যাচ্ছেন কাঙ্খিত সাফল্যের পথে। বর্তমানে কর্মরত আছেন বিশ্ব বিখ্যাত অনলাইন রিটেইলার ও প্রথম ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানি ‘আমাজন’ এ কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স স্পেশালিস্ট হিসেবে। এরআগে, সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন টেলিফোনের আবিস্কর্তা গ্রাহাম বেলের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ও বর্তমানে পৃথিবীর বৃহৎ টেলিফোন কোম্পানি এটিএন্ডটি-তে। সবার আগে, তাঁর প্রতিভার দ্যুতিতে দীপ্ত করছেন দেশীয় টেলিফোন কোম্পাানি গ্রামীন ফোনকে।
কর্পোরেট দুনিয়ায় সাফল্যের দ্যুতি ছড়ানোর গল্প তিনি শুনিয়েছেন সময় জর্নালকে। পাঠকদের জন্য সেসব হুবহু তুলে ধরা হল।
ক্যারিয়ারের শুরুঃ
১৯৯৭ সালে গ্রামীণ ফোন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে অপারেশন শুরু করে। একই বছর আমিও গ্রামীনফোনে কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে যোগ দেই। আমার প্রাথমিক কর্মস্থল ছিল গুলশান নর্থ এভিনিউয়ের ইনফো সেন্টার। এই ইনফো সেন্টারই ছিল তখন গ্রামীনফোনের একমাত্র কাস্টমার টাচপয়েন্ট, যেখান থেকে কাস্টমার ফোন কেনা থেকে শুরু করে, যাবতীয় কাজের জন্য আসতে পারতেন। আমি সেখানে যোগ দেয়ার আগে পর্যন্ত কেউ স্থায়ীভাবে ইনফো সেন্টার কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করতেন না, সম্ভবত কাজের তেমন চাপ ছিলনা বলেই। আমি যোগ দেয়ার পর স্থায়ীভাবে সেখানে কাজ শুরু করি।
স্ট্রাগলঃ
প্রথম দিকে কাজের কোন নির্দিষ্ট ধরন ছিলনা, ছিলনা কোন গাইডলাইন বা প্রসেস। পুরোটাই ছিল অনুমান নির্ভর বা কমন সেন্স নির্ভর। সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকি, বুঝতে শিখি কোন পরিস্থিতিতে কি করা উচিত, মানুষের সাইকোলজি বুঝতে শিখি, মানুষের সাইকোলজি বুঝতে পারাটা খুব জরুরী যারা ফ্রন্ট লাইনে কাজ করে তাঁদের জন্য। এসবই ছিল খুব কষ্ট করে শেখা, নিজের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে,তবে স্ট্রাগল করে এই শেখাটায় সারাজীবন কাজে দিয়েছে। আমার পরে যারা এই টিমে যোগ দিয়েছে তাঁদের জন্য একটা একজাম্পল হিসেবে কাজ করেছে আমার কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতা।
অন্য যেকোন কোম্পানির মতই গ্রামীনফোনেও কাস্টমার সার্ভিস প্রাথমিক অবস্থায় প্রায়োরিটি লিস্টে বেশ পরেই ছিল। তবে ধীরে ধীরে এই মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে, ম্যানেজমেন্ট বুঝতে পেরেছেন, নতুন কাস্টমার যুক্ত করায় শুধু নয় বরং আগের কাস্টমারদের ধরে রাখতে পারাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিংবা অনেক ক্ষেত্রে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ ব্যবসা সফল কোম্পানি তাই কাস্টমার সার্ভিস বা কাস্টমার এক্সপেরিএন্সকে অনেক বেশী গুরুত্ব সহকারে দেখছে।
গ্রামীনফোনে আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যা স্মরণ করতে আনন্দ পাইঃ
২০০৫ সালে গ্রামীনফোনের প্যারেন্ট কোম্পানি টেলিনর সিদ্ধান্ত নেয় কাস্টমার সার্ভিসের ফ্রন্ট লাইন কে একটা সিঙ্গেল প্লাটফরমে নিয়ে আসার। ফলশ্রুতিতে বর্তমানের গ্রামীণ ফোন সেন্টার বা জিপিসি তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। আমি প্রথম থেকেই এই জিপিসি প্রজেক্টের কোর কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই আমার কাস্টমার সার্ভিসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার জন্য, এবং একই সাথে জিপিসির কাস্টমার সার্ভিস ও এর মানব সম্পদের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হই। কাস্টমার সার্ভিসের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজিউর (SOP) তৈরি করা ছিল একটা বেশ কঠিন, পরিশ্রমসাধ্য কিন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ডকুমেন্ট, অনেকটা সংবিধানের মত; এটা তৈরি করা ছিল আমার জন্য খুবই সম্মানের একটা কাজ। আর সারাদেশে এই জিপিসির জন্য উপযুক্ত লোকবল তৈরি করাটাও ছিল অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। সবমিলিয়ে তুলনামূলক নতুন একটা ইন্ডাস্ট্রি ও কোম্পানির জন্য একটা স্থায়ী কাস্টমার সার্ভিস গাইডলাইন তৈরি করা এবং জিপিসি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করা আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
পরবর্তীতে আমি গ্রামীনফোনের সর্ববৃহৎ এই কাস্টমার সার্ভিস চ্যানেল বা জিপিসির জন্য ফ্রাঞ্ছাইজি অপারেশন চালু করি। কোম্পানির খরচ কমিয়ে অভিজ্ঞ ও কাস্টমার সার্ভিসের প্রতি আগ্রহ আছে এমন ব্যাবসায়িদের নিয়োগের মাধ্যমে শতাধিক জিপিসির একটা ক্ষুদ্রতর ভার্শন তৈরি করি। এটাও জিপির মালিকানাধীন জিপিসির মতই একই ধরনের সার্ভিস স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে কাস্টমার সার্ভিস দিতে সক্ষম।
২০১৩ সালের শেষে জিপি থেকে বিদায় নেয়ার আগে পর্যন্ত গ্রামীণফোন সেন্টারের (জিপিসি) অপারেসন্স হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
গ্রামীনফোনের পরে আমার ক্যারিয়ারঃ
AT&T :
গ্রামীনফোন থেকে আমি এরপরে চলে আসি AT&T তে, আমেরিকার সর্ববৃহৎ ও পৃথিবীর প্রথম ফোন কোম্পানি যার ফাউন্ডার ছিলেন টেলিফোনের উদ্ভাবক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। সিনিয়র কন্সাল্টান্ট হিসেবে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে কাজ শুরু করে প্রায় দেড় বছর কাজ করি। এখানেও কাস্টমার সার্ভিসে অনেক নতুন টেকনিক ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে জানি, একই সাথে বেশ কিছু গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়ে কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ আসে। তবে কাস্টমার সার্ভিসের বেসিক প্রিন্সিপল সব জায়গাতেই এক। কাস্টমার ইজ দ্যা কিং!
আমাজনঃ
AT&T থেকে চলে এসে ২০১৮ সালে যোগ দেই আমাজনে, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ অনলাইন রিটেইলার ও প্রথম ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানি হিসেবে খ্যাত। প্রসেস স্পেশালিষ্ট হিসেবে কাজ শুরু করলেও লম্বা একটা সময় কাজ করি প্রায় প্রতিটা আলাদা ফাংশনে। কাজের ধরন ও এর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। আমাজনের এমনটাই নিয়ম।
যে কোন পদেই যোগ দিক না কেন তাঁকে কোম্পানির বিভিন্ন লেভেল সম্পর্কে সম্যক ধারনা রাখতে হবে। কাস্টমার সম্পর্কে জানতে হবে, কাস্টমারকে সন্তস্ট করার প্রতিটি স্টেপস সম্পর্কে ধারনা রাখতে হবে এবং একে কাজ লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
আমাজনের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট এরও কাস্টমারকে গিয়ে প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিয়ে আসার অনেক সুন্দর ও উল্লেখযোগ্য উধাহারন আছে। ফলে এখানে একদম উপর দিকের লিডারশীপও জানে একদম এন্ট্রি লেভেলের কাজ সম্পর্কে, তাঁদের কষ্ট কিংবা অভিজ্ঞতা সম্পর্কে।
ফলে আমাজন টপ ম্যানেজমেন্ট সবচেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয় এর তুলনাহীন কাস্টমার সার্ভিসের ব্যাপারে। যেকোন অবস্থাতেই কাস্টমারের কথাই শেষ কথা। বেশ বড় অংকের একটা বাজেট আছে আমাজনের- যদি কোন কাস্টমার কোন কারণ ছাড়াই কোন প্রোডাক্ট রিটার্ন করে সেজন্য। কিন্ত কাস্টমার যেন অসন্তস্ট না হয়! আর এই কাস্টমার সার্ভিস কালচার এডাপ্ট করতে পারাটা আমাজনে কাজ করতে পারা ও টিকে থাকার মূলমন্ত্র!
আমার গ্রামীনফোনের কাস্টমার সার্ভিসের প্রায় ১৭ বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে আমাজনের এই কাস্টমার সেন্ট্রিক কালচারের কারণে। আর আমাজনের এই সার্ভিস বাকি সব বড় কোম্পানিগুলোর জন্য টার্গেট। বর্তমানে আমি আমাজনের কোয়ালিটি এসুরেন্সে কাজ করছি।
নতুনদের জন্যঃ
আপনি যে ইন্ডাস্ট্রি বা কোম্পানিতেই কাজ করুন না কেন, আপনার কাজকে ভাল বাসতে জানতে হবে। কাজ করে যদি আনন্দ না পান, তাহলে মনে রাখবেন এই কাজ আপনার জন্য নয়। অথবা কাজটাকে এত ভাল করে শিখে নিবেন যাতে অন্য কেউ আপনার চেয়ে ভাল ভাবে করতে পারবেনা। ফলে আপনি একসময় সত্যিই ভালবেসে ফেলবেন আপনার কাজটাকে। বিশ্বাস করুন, কাজ যদি ভালভাবে শিখতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আপনি উপভোগ করবেন আপনার কাজ।
আপনি সেলস, টেকনিক্যাল, কাস্টমার সার্ভিস বা ফিনান্স অথবা অন্য যেকোন বিভাগেই কাজ করুন না কেন- আপনাকে জানতে হবে কে আপনার কাস্টমার। যিনি আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস নিয়ে থাকেন তিনিই শুধু আপনার কাস্টমার নন। বরং প্রতিদিন যাদের সাথে আপনার দেখা হয়, কথা হয় এঁরা প্রত্যকেই আপনার কাস্টমার। এঁদের সকলকেই সম্মান করুন। মনে রাখবেন আপনার ভিতরে কাস্টমার সেন্ট্রিক কালচার তৈরি করাটা খুব জরুরী।
সবার মধ্যে এই কাস্টমার কালচার তৈরি হলে তবেই একটা কোম্পানি একটা টীম হিসেবে কাজ করতে পারবে। সফল হতে পারবে।
কন্টিনিউয়াস ইম্প্রুভমেন্ট করতে হবে নিজের। সেই কবে কলেজ বা ইউনিভারসিটিতে কি শিখেছেন তাঁর উপর নির্ভর করে বসে থাকবেন না। প্রতিদিন পৃথিবী পরিবর্তিত হচ্ছে। নিজেকে আপডেটেড রাখুন, নতুন স্কিল সেট তৈরি করুন, নিজের চেষ্টায় নতুন নতুন স্কিল অ্যাড করুন নিজের ঝুলিতে। লিঙ্কডিন একাউন্টে নিজেকে আপডেটেড রাখুন, আর নেটওয়ার্ক তৈরি করুন। বিভিন্ন মানুষের সাথে প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে নিজের চেনা জানার পরিধি বাড়ান। আপনার নেটওয়ার্কের একজন মানুষ আপনাকে সবচেয়ে বেশী হেল্প করতে পারবে যখন আপনি নতুন কোন কাজে যোগ দিতে চান, অথবা নতুন কিছু শিখতে চান। কিংবা ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের জন্য কোন পরামর্শ দরকার। নেটওয়ার্কিং বাড়ান ও একে কাজে লাগান। নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করুন। নিজেকে তুলে ধরুন পৃথিবীর সামনে।
আনোয়ার এমডি হোসেইন
ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভেনিয়া, USA
e-mail: War216@gmail.com
Linkedin: https://www.linkedin.com/in/anwarmdhossain/
সময় জার্নাল/ইএইচ