আব্দুন নূর তুষার : ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে কি কি সুবিধা পাওয়া যাবে সেটা সরকারের পোর্টালে বলা আছে। এই নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। যেখানে বাল্যবিবাহ, জমির পরচা সহ নানা রকম সমস্যায় সমাধান পাবার কথা বলা হয়েছে। অতি সম্প্রতি জরুরী খাদ্য সেবা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে এই সেবায়। টেলিমেডিসিনও যুক্ত হয়েছিল তার আগে। এখানে কোথাও বলা হয় নাই ঠিক কোন সীমারেখা দিয়ে খাদ্য সহায়তা পাওয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তি নিজে নিজের স্বয়ং নির্বাচন বা সেলফ অ্যাসেসমেন্ট করবেন।
এক দরিদ্র ব্যক্তি এরকম সহায়তা চেয়ে বিপদে পড়েছেন। একজন থানা নির্বাহী কর্মকর্তা বিচার করে দেখেছেন যে এই ব্যক্তি খাদ্য সহায়তা পাবার যোগ্য নন। এটা হতেই পারে। যোগ্য নন বা প্রশাসণ যোগ্য মনে করছে না এমন ব্যক্তি সাহায্য চাইতে পারেন।
সে জন্য তার কি শাস্তি হবে? শাস্তি দেয়ার আগে কি আমরা নিশ্চিত যে এই সেবাটি সম্পর্কে আমরা মানুষকে সঠিকভাবে জানিয়েছি?
১. সহজে দ্রষ্টব্য এমন কোন জায়গায় এই বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা নাই কে এই সাহায্য চাইতে পারেন বা পারেন না।
২. এটা ভুল করে চাইলে সেটা যে অপরাধ সে বিষয়েও কোন সঠিক ব্যাখ্যা বা তথ্য নাই।
যদি কেউ এটা ভুল করে নিয়ে থাকেন তবে তাকে সেই নিয়ে ফেলা সহায়তা ফেরত দিতে বলা যেতে পারে।
তিনি সেটা খেয়ে ফেললে, তাকে সম পরিমান খাবার কিনে দিতে বা সমপরিমান অর্থ ফেরত দিতে বলা যেতে পারে। সেসব না করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে ১০০ জনের সমপরিমান খাবার বিতরন করতে বিচারিক নির্দেশ দিয়েছেন। নিজের ইচ্ছামতো এরকম করার স্বাধীনতা হয়তো তার আছে কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে কতটা নির্দয় ও অবিবেচনাসুলভ সেটা এরি মধ্যে প্রকাশিত হয়ছে।
এই ধরনের ক্ষমতার বাহাদুরী আমরা করোনাকালের শুরুতে দেখেছি। তার আগেও দেখেছি। এখনো দেখছি। ভ্রাম্যমান আদালত বা নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে পরিচালিত কোন আদালত যে প্রয়োজনেই সৃষ্ট হোক না কেন এর মধ্যে বিচারকের ডিসক্রিশনারী জরিমানা করা বা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকা মানেই হচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ তৈরী করা। এই ধরনের নির্বাহী বিচার আচার নিয়ে ২০১৭ সালের ১১ মে হাইকোর্ট এর সুস্পষ্ট রায় আছে। যেখানে একে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলা হয়েছে।
হাটহাজারীতে সাকিব নামে একটি ছেলে এরকম একটি ভুল ফোন করায় তাকে কিন্তু শাস্তি পেতে হয় নাই। কিন্তু ফরিদ সাহেবকে ১০০ লোকের খাবার প্রদান করার একটি তুঘলকি শাস্তি দেয়া হয়েছে। এর কারণ হলো এই শাস্তি বা জরিমানা যার যেমন ইচ্ছা সেভাবে দেয়ার সুযোগ থাকা। একজনের কিছুই হলো না। আরেকজন বেচাবিক্রি করে, ধার নিয়ে প্রায় নি:স্ব হবার উপক্রম।
কেন একজন ব্যক্তি এরকম একটি ফোন করলে তাকে স্বয়ং ইউ এন ও কে গিয়ে নিজহাতে এই খাদ্য দিতে হবে? কেন এই সহায়তা দেবার পরে স্থানীয় পত্র পত্রিকা অনলাইনে সেটার সংবাদ হতে হবে? প্রশাসনিক দায়িত্ব চাকুরির আবশ্যিক বিধান। এই কাজ যিনি করছেন তিনি সরকারের নির্দেশে করছেন। সরকারের পয়সায় করছেন। তিনি কোন হাতেম তাই না। তাহলে নিজ হাতে খাবার দিলেন অমুক , এসব কেন প্রচার করতে হবে। প্রতিদিন বহু গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে সই দেন এই কর্মকর্তারা। তারা বহু সিদ্ধান্ত নেন। সেগুলো কি এভাবে প্রচার করা হয়?
এই ধরনের জনসেবা সারা দেশে হচ্ছে । সব কর্মকর্তা কি এইসব কাজের প্রচার করছেন?
আবার শাস্তি প্রসংগে আসি।
কানে ধরানো। প্রহার করা। সাধ্যের অতিরিক্ত জরিমানা। এসব কি সঠিক? আমরা করোনার শুরুতে কানে ধরানো ও প্রহার দেখেছি ভিডিওতে। কোন যুক্তিতে বা চিন্তার ভিত্তিতে ফরিদ সাহেবকে ১০০ জনকে খাদ্য সেবা দেয়ার বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলো? কোন ধরনের সাধারন বিচার বুদ্ধিতে কাউকে ১০০ গুন জরিমানা চাপিয়ে দিয়ে একটি নির্দেশ দেয়া হয়?
এখন বলা হচ্ছে যে এই টাকা তাকে ফেরত দেয়া হবে। টাকা ফেরত দিলেন কিন্তু তাকে যে জনসমক্ষে হেয় করলেন সেটার জন্য কি করা হচ্ছে?
জনগণের কাছে রাষ্ট্র একটি অদৃশ্য ধারণা। রাষ্ট্র বা প্রজাতন্ত্র তখনি তার কাছে সেবক বা তার রক্ষক হিসেবে প্রতিভাত হয় যখন রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা তার প্রতি সদয় আচরণ করে। তাকে জুলুমের হাত থেকে প্রতিরক্ষা দেয়, তাকে অপরাধীর কাছ থেকে নিরাপত্তা দেয়, তার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করে। ফরিদ সাহেবকে এরকম নিবর্তনমূলক শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে আমাদের প্রশাসকদের অনেকের মধ্যেই বৃটিশ ঔপনিবেশিক রাজতান্ত্রিক মানসিকতা কেবল বসবাসই করছে না, ক্ষেত্র বিশেষে তা দানবীয় চেহারা নিয়েছে।
এই ধরনের আচরণে ক্ষতি হয় রাজনীতির। মানুষ মনে করে রাজনীতিবিদরা তাদের প্রতিনিধি। তারা মনে করে রাজনীতিবিদরা দেশকে নিয়ন্ত্রন করেন। তারা যখন এভাবে নির্বাহী স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয় তখন রাজনীতিবিদদের ওপরে মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা দুটোই কমে যেতে থাকে।
একটি এলাকার মানুষকে সবচেয়ে বেশী চেনেন এলাকার রাজনীতিবিদেরা। ত্রাণ বিতরণ সহ এ ধরনের কাজে সৎ নিষ্ঠাবান স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ত না করলে এরকম তুঘলকি আচরণ আরো হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
৩৩৩ সংক্রান্ত ওয়েব সাইটে খাদ্য সেবার বিষয়টি এখনো আপডেটেড না। সর্বশেষ হালনাগাদ গতবছর ১৩ ডিসেম্বর। কোন বিষয়ে ভালো করে না জানিয়ে সেটার ব্যবহার অপব্যবহার নিয়ে শাস্তি দেয়ার বিষয়টি সেবার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। উন্নয়ন একটি আর্থিক বা বস্তুগত বিষয় নয়। চিন্তা ও বুদ্ধির উন্নয়ন ও একই সাথে মানবিকতার উন্নয়ন ছাড়া আমাদের পয়সা কড়ির বাড়াবাড়ি আসলে আটলান্টিস নগরীর গল্প প্রস্তুত করবে। যে নগরী হারিয়ে গেছে সবকিছু থাকার পরেও।
মানুষের পৃথিবী মানুষের মানবিকতায় বেড়ে ওঠে. ক্ষমতাবানের ক্ষমতার বাহাদুরীতে না। উপকারের সময় দুবার চিন্তা করার দরকার নাই কিন্তু শাস্তি দেবার সময় বারবার চিন্তা করতে হয়। সেটাই মানবিকতা।
লেখক : চিকিৎসক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব