শামসুল আরেফীন :
পিতা-মাতা একেবারে স্বার্থহীনভাবে সন্তান লালন পালন করেন- এরকম একটা বয়ান সমাজে চালু আছে।
এ বয়ান যারা প্রচার করেন তারা নিজেদের পিতা-মাতা সুলভ অবস্থান থেকেই তা বলেন।
কথাটা ইউনিভার্সাল ট্রুথ বোধ হয় না।
সব পিতা-মাতা স্বার্থহীন ভাবে সন্তান লালন-পালন করেন না।
এরকম অনেক বাবা-মা পাওয়া যাবে যাদের সন্তান লালন পালন কোনভাবেই স্বার্থহীন না।
কোনো কোনো বাবা-মায়ের কাছে সন্তান একটা ডিপিএস স্কিম।
খুব ছোটবেলা থেকেই ডিপিএস স্কিম বাছাই করা হয়।
যেমনঃ সন্তান পড়াশোনায় ভালো হলে-
১) ডিপিএস ডাক্তার স্কিম
২) ডিপিএস ইঞ্জিনিয়ার স্কিম
এ দু'টো ডিপিএস স্কিম এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয়।
এ স্কিমের আওতায় সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই একাধিক মাস্টার রেখে বাসায় প্রাইভেট পড়ানো হয়। ঘি আর ননীটুকু খাইয়ে বড় করা হয়। স্ট্রংগার আর শার্পার হবার জন্য দেয়া হয় হরলিক্স। এক্সামে ১০০ তে ২ নম্বর কম পেলে বাবা-মায়ের ঘুম হারাম। পাশের বাসার ভাবীর বাচ্চার চেয়ে নিজের বাচ্চাকে অবশ্যই বেশি নম্বর পেতে হবে।
ইন্টার পাশ পর্যন্ত একটা বাচ্চার শৈশব, কৈশোর সব ধ্বংশ করে তার পেছনে বড় বিনিয়োগ এর জন্য তৈরি করা হয়।
সরকারি মেডিকেল/ইঞ্জিনিয়ারিং এ টিকে গেলে তো ভালোই। ডিপিএস স্কিমের মেগা প্রিমিয়ামটা দেয়া লাগলোনা।
আর না টিকলে সবচেয়ে মেগা প্রিমিয়াম টা দিতে হয় বেসরকারি মেডিকেল/ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি করাতে।
১৪/১৫ লাখ টাকা এককালীন প্রিমিয়াম দিয়ে বাবা-মা অপেক্ষা করতে থাকেন ডিপিএস ম্যাচিউর হবার আশায়।
সন্তান এমবিবিএস/বিএসসি পাশ করার মধ্য দিয়ে ডিপিএস ম্যাচিউর হয়।
এই সময়টাতে অনেক বাবা-মা'কে তাড়াহুড়ো করতে দেখা যায়।
সন্তান ডাক্তারি পাশ করে ১ মাসও ঘরে বসে থাকুক এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন না তারা।
P2A তে ৪২ বিসিএস এর ক্লাস করানোর সময় এমন অনেক অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের ডাক্তারকে দেখেছি যাদের এক্সামের ২ মাস আগে থেকে ক্লিনিক ডিউটি করার বাধ্যবাধকতা না থাকলে তারা এক্সামে ভালো করতো।
এতোদিন তিলে তিলে বিল্ড আপ করা ম্যাচিউর ডিপিএস থেকে প্রাপ্ত লাভটা এক মাসের জন্য বন্ধ রাখতে পারেন না এসব মহান পিতা-মাতা।
অথচ ক্যারিয়ারের এই সময়টায় পরিবার থেকে অর্থনৈতিক সাপোর্টটা বেশি দরকার।
আরেকরকম ডিপিএস স্কিম আছে।
এটাকে বলে, অলরাউন্ডার ডিপিএস স্কিম। সাধারণত মায়েরা-ই এই স্কিমে আগ্রহী বেশি।
অলরাউন্ডার ডিপিএস স্কিমে মায়েরা চান তার সন্তান হবে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মতো আর্টিস্ট, সাকিব আল হাসান এর মতো ক্রিকেটার, দেবী শেঠীর মতো ডাক্তার, মান্না দে'র মতো সিংগার, ঋত্বিক রোশানের মতো ডান্সার এবং শাহরুখ খানের মতো এক্টর।
ও হ্যাঁ, ডা. জাকির নায়েকের মতো ইসলামিক বক্তাও হতে হবে।
একের ভেতর পাঁচ আর কী!
এ স্কিমে সন্তানের জন্য নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, চিত্রাংকন শেখানোর আলাদা আলাদা টিচার রাখা হয়। ইশকুলের সাবজেক্টের জন্য রাখা হয় বিষয়ভিত্তিক টিচার+ হুজুর। ক্রিকেট খেলা শেখার ব্যবস্থা থাকলে সেখানেও পাঠানো হয়।
দিনের ২৪ ঘন্টায় খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া বাকী সময় চলতে থাকে প্রজেক্ট অলরাউন্ডার বানানোর মিশন।
দুপুর ২ টায় ডান্সের মাস্টার এলে বিকেল ৪ টায় আসে গানের মাস্টার। বিকেল ৫ টায় আবার আর্ট শেখানোর মাস্টার। সন্ধ্যা ৭ টায় অংকের মাস্টার এলে রাত ৮ টায় আবার ইংরেজির মাস্টার।
উইকএন্ডে আবার সাকিব আল হাসান বানাতে স্টেডিয়াম গমন।
অলরাউন্ডার স্কিমের আওতায় থাকা সন্তানরা প্রত্যাশার চাপে অনেক সময়ই ভেঙ্গে পড়ে।
আরো নানান রকম স্কিম আছে।
ডিপিএস মিডল ইস্ট স্কিম, ডিপিএস যৌতুক স্কিম........
আমি আমার দ্বীপে এমন অনেক বাবা-মা'কে দেখেছি যাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হচ্ছে সন্তান একসময় মিডল ইস্ট যাবে।
অনেক টাকা কামাবে। সেভাবেই তাদের রেডি করা হয়।
দু'চারটা ছেলে থাকলে ডিপিএস যৌতুক স্কিমও খুব একটা রেয়ার ঘটনা না।
আমি আমার একজন আত্মীয়কে দেখেছি। ছেলে প্রতি যৌতুক হিসেবে কয়েক লাখ টাকা আদায় করে গর্বিত হয়েছেন। এক ছেলেকে একাধিক বিয়ে করিয়ে একাধিকবার যৌতুক আদায়ের ঘটনাও আছে।
ছেলে প্রতি কতো আয় হলো এটা বেশ রসিয়েই উনি বলেন।
একেবারে সফল ডিপিএস যাকে বলে আর কী!
বাবা-মায়ের ডিপিএস প্ল্যানগুলো কখনো কখনো সফল হয়। কখনো কখনো সেটা মেট লাইফের ডিপিএস নামক ভন্ডামি হয়ে যায়। এই ব্যর্থতা উনারা মেনে নিতে পারেন না।
"তুই একটা অপদার্থ। তোর দ্বারা কিছুই হইলোনা!"
এই দীর্ঘশ্বাস সন্তানের উপর ঝাড়তে থাকতে থাকেন জীবনভর।
নিজেরা যা হতে পারেননি সেটা তারা সন্তান এর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সন্তান ব্যর্থ হলে পুঁজি হারানোর ক্ষোভ সন্তানের উপর বর্ষণ করতে থাকেন।
কাঙখিত লভ্যাংশ না পেলে (মেটলাইফ এর মতো) তখন আবার বলতে শোনা যায়,
"এতো পড়ালেখা শিখায়ে কী লাভ হলো!"
পিতা-মাতা যে লাভ/লোকসান ভাবেন সেটা এই এক কথাতেই অনেক সময় বেরিয়ে আসে।
আমাদের দেশে অবাধ্য সন্তান, নষ্ট সন্তান এরকম নানান টার্ম আছে।
কিন্তু লোভী পিতা-মাতা বলে কোন টার্ম নেই।
*আমার পুরো লেখায় ছেলেদের উদাহরণ দেয়া হয়েছে।
কারণ আমি ছেলে হিসেবে- অজস্র ছেলের বোবা কান্নার সাক্ষী।
লেখক : ডিজিটাল মার্কেটিং কো-অর্ডিনেটর, সিনিয়র সিটিজেন হসপিটাল।