চন্দ্রিকা চক্রবর্তী
পৃথিবীতে যতোগুলো সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ, তন্মধ্যে মাতাপিতার সাথে সন্তানের সম্পর্কটি সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে। একটি সন্তানের জন্য এই পৃথিবীতে পিতা-মাতা থেকে আর কেউ বেশি আপন হতে পারে না। কারণ, তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, যার প্রাপ্যতা পৃথিবীতে একেবারেই দুর্লভ। এই পৃথিবীর আলো দেখা থেকে শুরু করে অফুরন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারা যায় শুধুমাত্র পিতামাতার জন্যই।
প্রত্যেক ধর্মেই পিতামাতাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে বলা হয়েছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, "মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত"। হিন্দুশাস্ত্রে মাতাকে নিয়ে বলা আছে " জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী" এবং পিতাকে নিয়ে বলা হয়েছে "পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম"।
একটি সন্তান শৈশব থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও পিতামাতা তার সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে কখনো অবহেলা করেন না। যেমনঃ শৈশবে সন্তানকে খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, শারীরিক যত্নের দিকে বেশি খেয়াল রাখা কারণ তখন শিশু নিজের ভালো বুঝতে পারে না-এই কাজগুলো পিতামাতা করেন। সন্তানের লালন-পালন, ভালোবাসা এবং যত্ন নেওয়ার প্রাথমিক কাজটি এই ধাপেই সম্পন্ন হয়।
শিশু যখন মোটামুটি বয়সে বড় হয় অর্থাৎ, অঙ্কুর থেকে বিকশিত হওয়া শুরু করে, তখন তাকে শিক্ষাদান এবং সঠিক অভিভাবকত্বের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল সময় হলো কৈশোরকাল। কারণ, এসময় শিশুটির শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সাধিত হয়। তারা কিশোর কিশোরী নামে অভিহিত হতে শুরু করে। তাদের আবেগের স্থিতিশীলতা থাকে না এসময়। তাদের বোঝা, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কিংবা অতিরিক্ত স্বাধীনতা না দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় গড়ে তোলার কাজটিও পিতামাতাই করেন।
যৌবন পার করে যখন সন্তানটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়, তখন তাকে উপযুক্ত দিকনির্দেশনা দিয়ে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জনে সহায়তা করা এবং মনোবল প্রদান করার কাজটি পিতামাতা করেন।
প্রতিটি ধাপেই সন্তানকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় দিয়ে তাকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু অনেক পিতামাতা এখন কর্মব্যস্ততার চাপে এই সময়টুকু দিতে ব্যর্থ হন, যা শিশুর বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এইদিকে প্রত্যেক পিতামাতার সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।
পিতামাতা সন্তানের জন্য যা করেন, তার ঋণ কখনো সন্তান পরিশোধ করতে পারে না। তবে, পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে অবশ্যই পারে। প্রতিটি সন্তানের উচিত তাদের পিতামাতার আদর্শ ও ন্যায়নীতি অনুসরণ করে চলা, তাদের অনুগত হয়ে থাকা, সমাজে তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হয় এমন কোনো কাজ না করা, সর্বদা সদ্ব্যবহার করা এবং কোমল কন্ঠে মার্জিত ভাষায় কথা বলা। সেই সন্তান যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে, তখন পিতামাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া। সর্বোপরি, তাদের যখন বার্ধক্য চলে আসে, তখন অসুস্থ পিতামাতাকে সেবাশুশ্রূষা করা, চলতে ফিরতে অক্ষম হয়ে পড়লে তাদের চলাফেরায় সহায়তা করা। কারণ, তখন এককালে নবজাত শিশুটিকে বড় করে তোলা পিতামাতাই নিজেরা নবজাতক শিশুর মতো অসহায় হয়ে যায়।
তবে, আজকাল এই ক্ষেত্রে সন্তানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় ব্যাপক উদাসীনতা ও অবহেলা। যার দরুন বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে উপেক্ষিত বৃদ্ধ পিতামাতার সংখ্যা।
যে পিতামাতা নিজে না খেয়ে, না পরে তার সন্তানকে খাইয়ে পরিয়ে যান, তাদেরই শেষ বয়সে খাওয়া-পরার ভারটুকু নেওয়ার মতো ক্ষমতা থাকলেও অনেক সন্তানই নেয় না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। সকলের স্মরণ রাখতে হবে, মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালনের মধ্যেই রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি। কারণ, সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য স্বীকারের পরই পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন সকল ধর্মে স্বীকৃত। পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভ করে পৃথিবীতে স্মরণীয় ও বরণীয় হওয়া যায়।
লেখিকা : শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
সময় জার্নাল/এসএ