মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে সাতক্ষীরার উপকূলী উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জের দশটি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ও মৎস্য ঘেরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কমপক্ষে ২২টি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এবং ৩৪ টি স্থানে উপচে পড়া পানিতে জেলার কমপক্ষে ৬০ টি গ্রাম কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে কমপক্ষে সাড়ে চার হাজার মৎস্য ঘের।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় সব চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর, গাবুরা, কৈখালী, নুরনগর ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে ৯৫০ হেক্টর জমির দুই হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। টাকার হিসেবে ক্ষতি পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আশাশুনি সদর, বড়দল ও খাজরা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমির দুই হাজার ৫৬০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। টাকার হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবের পর উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে উপকূলীয় বাঁধ উপচে ও বাঁধ ভেঙ্গে ৪ হাজার ৫৬০ টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪ কোটি ২৩ লাখ টাকার। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আম্পানের থেকেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতির
পরিমাণ বেশী হয়েছে। বর্তমানে ঘেরের মাছগুলো সব বিক্রি উপযোগী হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে চাষীদের ক্ষতি হয়েছে অনেক।
এদিকে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ও পানি উপচে প্লাবিত হয়েছে আশাশুনি উপজেলার হরিখালী, চাকলা, কল্যাণপুর, রুইয়েরবিল, নাকনা, গকুলনগর, কুড়িকাউনিয়া, বলাবাড়িয়া, মানিকখালী. হাজরাখালী, গদাইপুর, কেয়ারগাতি, কালিগঞ্জ উপজেলার ঘোজাডাঙ্গা, কালিগঞ্জ সদর, বাজারগগ্রাম, নাজিমগঞ্জ, বসন্তপুর, হাড়দ্দহ, দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর, ভাতশালা, চরশ্রীপুর, টাউনশ্রীপুর, সুশীলগাতি, বসন্তপুর, নাংলা ও সখিপুর।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালীনি, রমজাননগর, নুরনগর
ইউনিয়নের প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সবমিলিয়ে জেলায় প্রায় ৬০ টি গ্রাম কমবেশী প্লাবিত হয়েছে।
বুধবার (২৬মে) সকালে জোয়ারের চাপে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরার জেলেখালি, নেবুবুনিয়া, চাঁদনীমুখা, গাগড়ামারি, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঝাপা গ্রামে বেড়িবাঁধের চারটি পয়েন্ট ও পাতাখালির দুটি পয়েন্ট ভেঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ পাতাখালি, কামালকাটি, ঝাঁপা ও সোনাখালিসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীর জোয়ারের পানিতে ভাসছে। উপজেলার রমজাননগরের দুটি পয়েন্ট, কৈখালির দুটি পয়েন্ট, ভেটখালি জামে মসজিদের সামনে
একটি পয়েন্ট, বুড়িগোয়ালিনীর তিনটি পয়েন্ট ও নূরনগর ইউনিয়নের একটি পয়েন্টসহ অন্তত: ১৭টি স্থানে নদীর পানি বেড়িবাঁধ উপচে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। পরে এসব বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় পানিতে সয়লাব হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম।
গ্রামবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বালির বস্তা এবং মাটি ফেলে বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
এছাড়া আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাট, হরিশখালি, চাকলা, রুইয়ার বিল, সুভদ্রকাটি, দিঘলারআইট ওকল্যানপুরসহ ৬টি পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে ওই ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ডের সব কয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একইসাথে আশাশুনি সদরের দয়ারঘাট ও বলাবাড়িয়ায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের পিরোজপুরের রাজবংশীপাড়ায় কপোতাক্ষ নদের বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আশাশুনির দয়ারঘাট ও বলাবাড়িয়ায় খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ উপচে পানি এলাকায় ঢুকে কয়েক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বড়দল ইউনিয়নের বামনডাঙ্গা
বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকছে।
দেবহাটা উপজেলার ইছামতী নদীর কোমরপুর নামকস্থানে বেড়িবাঁধ উপচে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাড়দ্দহ মসজিদের পাশে ও তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে টিআর এম এর বাঁধ ভেঙ্গে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন, গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিএম মাছুদুল আলম, পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এড. আতাউর রহমান, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবু ভবতোষ মন্ডল, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কামেশ মোড়ল, কৈখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ আব্দুর রহিমসহ স্থানীয়রা এসব তথ্য জানান।
এদিকে এ ভয়াবহ অবস্থার জন্য অর্ধশত বছর আগের সেই জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, দিন আসে, দিন যায়, বদলায় অনেক কিছু। শুধু বদলায় না উপকূলের বেড়িবাঁধের চেহারা। প্রতিবছর দুর্যোগ আসে, কিন্তু বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়না। ঠিক দুর্যোগ মুহূর্তে কিছু বালির বস্তা নিয়ে হাজির হয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিবছর মোটা
অংকের টাকা খরচ হয় কিন্তু বাঁধ ঠিকমত মেরামত বা নির্মাণ করা হয় না।
বরাদ্দের একটি মোটা অংকের টাকা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরুর আাগেই চলে যায় পাউবো’র কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পকেটে। ফলে বেড়িবাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মোট বরাদ্দের ২০ শতাংশের বেশি টাকার কাজ হয় না। তারা উপকূলের মানুষকে রক্ষা করতে পরিকল্পনা মাফিক টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, ইয়াসে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে বেড়িবাঁধের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দু’টি বিভাগ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। তালিকা পাওয়ার পর সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।
সময় জার্নাল/এমআই