সময় জার্নাল ডেস্ক:
পৃথিবীর বয়স বেড়ে যাবে আরো একটি বছর। পৃথিবীর কাছে একটি বছর হয়তো সংখ্যা মাত্র। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে এটা অনেক বড় একটা ঘটনা। কারো জন্য অর্জনের আনন্দ, কারো জন্য হারানোর বেদনা।
সাহিত্যের কালেন্ডারে বছরটি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বেশ কয়েকজন বরেণ্য লেখকের মৃত্যুর কারণে। যদিও আমরা জানি ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সৃষ্টিশীল মানুষের চিরবিদায় বলে কিছু নেই। তাঁরা বেঁচে থাকেন কর্মে, প্রেরণায়। তবু তাঁদের চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
বছরটি শুরু হয় লেখক, শিক্ষক ও সমাজসেবক সুফিয়া খাতুনের প্রস্থান দিয়ে। ৭ জানুয়ারি চলে যান ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে’ গ্রন্থের রচয়িতা সুফিয়া খাতুন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। আত্মজীবনী ‘জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে’ বইয়ে নদীর মতো প্রবহমান জীবনের গল্প তুলে ধরেছেন তিনি। ২০১৩ সালে পান একুশে পদক।
কানাডাপ্রবাসী কবি ও গল্পকার ইকবাল হাসানকে আমরা হারাই ১২ এপ্রিল। শহীদজায়া লেখক অধ্যাপক পান্না কায়সারকে আমরা হারাই ৪ আগস্ট। পান্না কায়সার ১৯৭৩ সাল থেকে শিশু কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি এই সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় অবদান রাখার জন্য তাঁকে ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
শোকের মাস আগস্টে চলে যান কবি মোহাম্মদ রফিকও। তিনি মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরে এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেন। কবিতার জন্য মোহাম্মদ রফিক একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার অর্জন করেছেন।
বছরের শেষ দিকে আমরা হারাই সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরীকে। তিনি ৫ অক্টোবর কানাডার টরন্টোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ষাটের দশকের কবি আসাদ চৌধুরী বাংলা একাডেমি থেকে পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।
কবি, গীতিকার ও ঔপন্যাসিক আজিজুর রহমান আজিজ মারা যান ৯ অক্টোবর। কবি, শখের অভিনেতা ও নাট্যনির্মাতা তারেক মাহমুদ চলে যান ২৬ অক্টোবর। কবি ও প্রাবন্ধিক সমরেশ দেবনাথ প্রয়াত হন ১২ ডিসেম্বর।
বিদায়ি এ বছরে সাহিত্যের পাশাপাশি শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের বেশ কয়েকজন বরেণ্য মানুষকে আমরা হারাই। গত মার্চ মাসে চলে যান একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শামীম শিকদার। অকাল প্রয়াত হন কার্টুনিস্ট শাহানারা নার্গিস শিখা। চলচ্চিত্রে আমরা চিত্রনায়ক ফারুককে হারাই মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে। অভিনেত্রী মিতা চৌধুরী চলে যান জুন মাসের শেষ দিকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ গত ১৪ জুলাই ভোরে মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ধরনের অসুখে ভুগছিলেন।
সংগীতজগতেও শোকের ছায়া নেমে আসে শিল্পী বুলবুল মহলানবীশের মৃত্যুতে। তিনি একাধারে লেখক, সংগীত ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পাশাপাশি উপস্থাপনাও করতেন। চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান চলে যান সেপ্টেম্বর মাসে। দেশের বহু সফল চলচ্চিত্রের নির্মাতা ছিলেন তিনি। সেপ্টেম্বরে চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকীকেও আমরা হারাই। তিনি কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার ও লেখক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। একই মাসে চলে যান একুশে পদকপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী জিনাত বরকতউল্লাহ। নৃত্যকলায় তিনি ২০২২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
ভারতের পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার চলে যান ৮ মে। দুই বাংলার কথাসাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের একজন ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা ভাষার পাঠকদের হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। ৮১ বছর বয়সে মারা যান ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’, ‘গর্ভধারিণী’, ‘সাতকাহন’সহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের এই লেখক।
বাংলা ভাষার প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে সুখ্যাত ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক সুবিমল মিশ্র চলে যান ৮ ফেব্রুয়ারি। তিনিও দুই বাংলায়ই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ‘হারান মাঝির বিধবা বৌ এর মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি’ শীর্ষক ছোটগল্প দিয়ে বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দেন তিনি।
অখণ্ড বাংলার আরেকজন জনপ্রিয় লেখক কবি মলয়রায় চৌধুরীও চলে যান বিদায়ি বছরে। গত ২৬ অক্টোবর ‘হাংরি জেনারেশন’ সাহিত্য আন্দোলনের জনক হিসেবে খ্যাত এই কবি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক হিসেবেও তিনি সুখ্যাত। ২০০৩ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি।
বছরের শেষের দিকে কবি, গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক আবু বকর সিদ্দিক এর মৃত্যু বাংলাদেশের সাহিত্যঙ্গনে শোকের পরিমাপ যেন সবকিছু ছাপিয়ে যায়। আবু বকর সিদ্দিক বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদ পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
সময় জার্নাল/এলআর