নিজস্ব প্রতিবদেক:
প্রফেসর পারভেজের সুশাসন ভাবনায় 'নাইন আই মডেল" এক অসাধারন আবিষ্কার। এবিষয়ে তার ভাবনা ও "নাইন আই মডেল" সম্পর্কে গবেষণা থেকে আমরা সরাসরি জানতে পারি। বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশের জন্যই সুশাসন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। সুশাসন সকল ধরনের সরকার ও সমাজের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুশাসন বলতে কি বুঝায় তা অনেকের কাছেই অস্পষ্ট এবং তর্কসাপেক্ষ, তা প্রশাসনিক ধারনায় নীতি হোক বা সামাজিক চিন্তা ধারায় সমন্বয়েই হোক। আমাদের ধারনা মতে, সুশাসনকে প্রকৃত সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা খুব একটা সহজ কাজ নয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ্রাসংগিক কারণ, সুশাসনের পটভূমি একটি দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। সুতরাং এ অবস্থান হতে বলা যায়, সুশাসনের সংজ্ঞা চ্যালেঞ্জিং, বিষয়টি জটিল, প্রয়োজন ভিত্তিক এবং সময়ের দাবি।
এজন্য, আমরা সতর্কতা অবলম্বন করি 'সরকার' ও 'সুশাসন' কে সমর্থক না করতে। কারণ সরকার শুধুমাত্র শাব্দিক অর্থেই সরকার নয়, বিশেষত এটি বিশ্লেষণ করে কিভাবে সরকার ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ ও এমন সমন্বয় করে, কিভাবে তারা নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে এবং কিভাবে এওকূল পরিবেশে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সাহম (২০০৩) এর মতে সুশাসন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সমাজ, এবছর প্রতিষ্ঠান তাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সমূহ গ্রহণ করে, নির্ধারণ করে এর এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত এবং কিভাবে তারা এ দায়িত্ব সম্পাদন করে। এমতাবস্থায় আমরা নিজেদের নিকট প্রশ্নের সম্মুখীন হই, আদৌ কি গণতান্ত্রিক আজে সুশাসন অর্জন করা সম্ভব? অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি, প্রতান্ত্রিক কিংবা অন্য যেকোন সমাজ ব্যবস্থায়/রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রশাসনের সুনিশ্চিতকরণ একটি অতি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গণতান্ত্রিক সকর এটা সুনিশ্চিত করে যে, সরকার তার জনগণের নিকট, জনগণের সম্পদের নিকট দায়বদ্ধ। তা সত্ত্বেও এটা মনে রাখা প্রয়োজন একটি সরকার সুশাসনের নিকট নিয়ে যাবেই-এটা অবশ্যম্ভাবী নয়। (ওকেই, ২০০৮) এই মরণে সুশাসনের ধারণা এমন একটি ধারণা বা অনুশীলন যা ধারণালব্ধ, উপযোগী অনুশীলিত এবং যা স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে ভার্যকারিতা দ্বারা নির্ধারণ করা যায়।
সুশাসন ব্যাতীত অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। সুশাসনের পূর্ব শর্ত হলো কার্যকরী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। সুশাসনের জন্য অতীব জরুরি বিষয় হলো-গণতান্ত্রিক সমাজ। জনগণের জীবন মান উন্নয়ন ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভবপর নয়। যতক্ষন না জনগণ সুশাসনের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়, মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, তথ্যের আদান-প্রদান বাধাহীন, সুসংহত হয় এবং বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তার মত প্রকাশ করতে পারে। অইনের শাসনের মানদন্ডের একটি সম্প্রসারিত রূপ হলো সুশাসন। এটি সমাজকে সুশাসিত বলা যায় তখনই, যখন ঐ সমাজে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে, কোন ব্যক্তি বা মহলের শাসন নয়। একটি আধুনিক সমাজ ব্যাপকভাবে সুশাসিত বলা যায় যখন আইন, শৃঙ্খলা, নিয়ম-নীতি সঠিক পথ। নির্দেশনা, কর্ম পরিকল্পনা নিষেধাজ্ঞা সকল পন্থারই অনুশীলন করা হয়।
সুশাসন জনগণের নিকট একটি তথাকথিত বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় যখন জনগণের প্রতিনিধি, সরকারি আমলা, আইন প্রয়োগকারী, নিনম-নীতিকে পাশ কাটিয়ে ব্যাক্তিগত লাভের জন্য শাসন শুরু করে। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার স্বৈরাচারী সরকার হতে পারে একনায়কতন্ত্রের অনুশীলন করতে পারে। সংসদীয় সরকারের ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে। উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে সকল নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের চিত্র একটি গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু উদ্বিগ্ন হতে হয় হা সত্যিই এই নির্বাচনের নামে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ একটি অসহায় অবস্থার সৃষ্টি করা হয়, শক্তি প্রদর্শনের নিমিত্তে রাজনৈতিক দলগুলোর অনুসারিরা কেবলই একটি সন্ত্রাসীদের শাসন বা দুর্নীতিবাজদের সরকার গঠনকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মূল সমস্যাগুলোর একটি হল, দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, উচ্চবিত্ত শ্রেণি, ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, সকলেরই ধারণা একই পৃথিবীতে সবার মত করে জন্ম নেওয়ার পরেও নিজেদেরকে তারা আরও বেশী মনে করে থাকেন। তাদের জন্যই আইন ও বিচার ব্যবস্থা বহাল থাকে, তাদেরকে আইনের উর্ধ্বে সেবা দেয়ার জন্যই হয়তোবা। এই দুঃখজনক পরিস্থিতিই দুর্নীতি, দুঃশাসন ও জনগণের দূর্ভাগ্যের জন্ম হয়। দূর্নীতির মোকাবেলায় যে দৃঢ় অবস্থান, নীতি, পদক্ষেপের প্রয়োজন তা শুধুমাত্র দূর্নীতিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য দুঃসাহসিকতারই সমকক্ষ। যদি সত্যিই দুর্নীতিকে মোকাবেলা করতে হয়, তবে চিন্তা, মানসিকতার পরিবর্তন ও ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা, পরিবর্তন উভয়কেই মোকাবেলা করতে হবে।
বৃহত্তর পরিসরে, সুশাসন বলতে জনগণের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণকে বোঝায়। সুশাসন একটি সরকারের কর্মনির্ধারণের পরিকল্পনা বোঝায়, যেখানে সরকার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পন্থার কার্যকরী পদক্ষেপের বাস্তবায়ন খাটাতে চায়। বাংলাদেশের সুশাসন ধারনা এমন হওয়া উচিত যেখানে গণমানুষের আশার প্রতিফলন ঘটবে। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক, ধর্মীয় পরিবেশের আবহে/প্রেক্ষাপটে। তখনই সুশাসনের আবির্ভাব ঘটে সরকারের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক নৈপুণ্যে। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর পুনর্গঠন, নির্বাচন ব্যবস্থা, সর্বোপরি শাসনের নজরদারি। সুশাসন না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিকশিত হতে পারে না। কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকাই সুশাসনের পূর্বশর্ত। সমাজকে গণতান্ত্রিকীকরণই সুশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন না হলে জনগণ শাসনে অংশগ্রহণ করতে পারে না, মানবাধিকার মর্যাদা পায়না, তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকে না এবং সুশীল সমাজ ও বিচার ব্যবস্থা হয় দুর্বল। (চলবে....) বই: এক পলকে একটু দেখা, অধ্যাপক পারভেজের জীবন ও দর্শন, অনুচ্ছেদ-৭।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিকস রিসার্চ (এনবিইআর)।