বুধবার, ফেব্রুয়ারী ৭, ২০২৪
সাইফ ইব্রাহিম, ইবি প্রতিনিধি:
কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম নিয়োগকে কেন্দ্র করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকদের একটি অংশ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়োগ বোর্ড বন্ধ রাখার, অন্যদিকে উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিয়োগ বোর্ড চালু রাখার দাবি জানিয়েছেন।
এ নিয়ে মঙ্গলবার (০৬ ফেব্রুয়ারি) দিনব্যাপী কয়েকদফায় দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাঁধার মুখে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নিয়োগ বোর্ড শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, ইবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে চাকরির প্রশ্ন ফাঁস ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসি ও দুদক। এদিকে এসব দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডসমূহ চালু রেখেছে কর্তৃপক্ষ। পূর্ব নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী আজ সকাল সাড়ে দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম নিয়োগের বোর্ড শুরু হওয়ার কথা।
এ নিয়ে সকাল ৯ টায় উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত সকল নিয়োগ বোর্ড বন্ধ রাখাসহ ১২ দফা দাবিতে প্রশাসন ভবন চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। পরে সকাল ১০টায় কর্মকর্তা সমিতি এবং কর্মচারী সমিতির কার্যনির্বাহি সদস্যরা এসব দাবি নিয়ে উপাচার্যের সাথে তার কার্যালয়ে দেখা করতে যান। এর আধা ঘন্টা পর প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠন শাপলা ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক ড. পরেশ চন্দ্র বর্মন, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রবিউল হোসেন, অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান এবং অধ্যাপক ড. মাহবুবুল আরফিনের নের্তৃত্বে উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকদের একাংশও উপাচার্যের সাথে কথা বলতে সেখানে উপস্থিত হন। তারাও উপাচার্যের বিরুদ্ধে চলমান তদন্তের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সকল নিয়োগ বোর্ড বন্ধ রাখা এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু চেয়ার নিয়োগদানের মাধ্যমে নিয়োগবোর্ড চালু করার দাবি জানান।
এসময় আলোচনার এক পর্যায়ে উপাচার্যের সাথে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। পরে কর্মকর্তা কর্মচারীরা কোনভাবে নিয়োগ বোর্ড সফল হতে দিবে না মর্মে উপাচার্যকে হুমকি দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে যান। এসময় তারা উপাচার্যকে ‘বিশ্ববেহায়া, বেয়াদপ এবং চোর’ বলে অভিহিত করে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। তারা পুনরায় গিয়ে প্রশাসন ভবন চত্বরে অবস্থান নেয় এবং পূর্বে ফাঁস হওয়া উপাচার্যের অডিওগুলো মাইকে বাজাতে থাকেন।
এর কিছুক্ষণের মধ্যে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কামরুল হাসান অনিকের নেতৃত্বে সহ-সভাপতি মৃদুল হাসান রাব্বি, নাইমুর রহমান জয়, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মজুমদার ছাত্রলীগ কর্মী বিপুল খান, শাহিন, হাফিজসহ শতাধিক নেতাকর্মী স্লোগান দিতে দিতে বিনা অনুমতিতে উপাচার্যের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। এবং নিয়োগ বোর্ড চালু রাখার দাবি জানিয়ে উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সেখানে আগে থেকে উপস্থিত উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ান।
এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই শিক্ষকদের দালাল এবং দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে গালিগালাজ করতে ও স্লোগান দিতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বাকবিতন্ডা হাতাহাতিতে রুপ নেয়। এসময় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তারা ব্যর্থ হন। দীর্ঘক্ষণ পর পরিস্থিতি শান্ত হলে উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনসহ উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ সেখানে উপস্থিত হয়ে ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিয়োগ বোর্ড চালু রেখে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান।
উপাচার্যের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে উপাচার্যের পেটুয়াবাহিনী দ্বারা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ এনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন উপাচার্য বিরোধী শিক্ষকরা। এসময় তারা কর্মসূচিতে ৪দফা দাবি তুলে ধরেন। এছাড়া একই অভিযোগ এনে প্রতিবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদের শিক্ষক ইউনিট ও শাপলা ফোরাম বিবৃতিও প্রদান করেন।
এদিকে তাদের অভিযোগ অস্বীকার করে উপাচার্য বলেন, ‘আমি এর সাথে কোন ভাবেই জড়িত ছিলাম না। শিক্ষকদের সাথে আলোচনা চলাকালীন ছাত্রলীগের প্রবেশ অনাকাঙ্ক্ষিত। তাদের এভাবে প্রবেশ করা উচিত হয়নি।’
এদিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাঁধার মুখে পড়ে সকাল থেকে নিয়োগ বোর্ড শুরু করতে পারেনি প্রশাসন। পরে দীর্ঘ ৫ ঘন্টা পর বিকাল সাড়ে তিনটায় উপাচার্যের বাসভবনে নিয়োগ বোর্ড শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় শেষ হয়। এর আগে শুরুতে একপর্যায়ে কর্মকর্তারা নিয়োগ বোর্ড হবে না বলে প্রার্থীদের বাসভবন থেকে বের করে দেন। পরে পুনরায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বাসভবনে ঢুকিয়ে দিতে দেখা যায়। প্রার্থীদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাসভবনের ফটক অবরোধ করে রাখেন এবং কর্মকর্তাদের ভেতরে ঢুকতে বাঁধা দেন। এসময় উভয়পক্ষের শিক্ষকরাও ফটকের সামনে রাস্তার দুই পাশে মুখোমুখি অবস্থান নেয়।
এর আগে, গতকাল ইমাম নিয়োগ নিয়ে টাকা লেনদেন সম্পর্কিত শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের হোয়াটসঅ্যাপে কথোপকথনের কয়েকটি স্ক্রীনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন ও উপাচার্যের নাম উঠে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি অস্বীকার করে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। এর সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।’
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ড নিয়ে কর্তৃপক্ষ যাদের যোগ্য মনে করবে তাদের নিয়োগ দিবে। এখানে ছাত্রলীগের কোন বিষয় নেই। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক থাকুক।’
এসময় উপাচার্যের কার্যালয়ের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেখানে যারা এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তারা ছাত্রলীগের সাবেক বিভিন্ন পদের নেতাকর্মী। তারা দীর্ঘদিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেক্টরে দিন মজুর হিসেবে কাজ করছে। এখন তারা যদি নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয়ে আন্দোলন করে তাহলে এখানে ছাত্রলীগের কিছু করার নেই।’
এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আজকে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি নজীরবিহীন ঘটনা। আমি বিষয়টি তে মর্মাহত। আমি মনে করি যারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের যে মান মর্যাদা সেটি নষ্ট করেছে। আমি এই বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ আশা করছি।’
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, ‘নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আর ছাত্রলীগের সাথেও আমার কোন যোগসূত্র নেই।’
সময় জার্নাল/এলআর