প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ:
দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ ব্যাংক রয়েছে জনসংখ্যার তুলনায় তা অপ্রতুল। অর্থনৈতিক কাঠামো বিকাশের স্বার্থে আরো ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আছে। ব্যাংকিং খাত হলো সেবা সেক্টর। সেবার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশের প্রয়োজনে বিশ্বময় ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয়েছিলো। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকিং সেবা প্রাপ্তি মানুষের অর্থনৈতিক ও জাতীয় অধিকার।
এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার জন্য ব্যাংক হলো মাত্র ৫৭টি। এর মধ্যে অপ ব্যবস্থাপনায় ডুবন্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ বলে থাকেন ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চলতে তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। এই ধারণা ভুল, তাদের ব্যাংকিং ও প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগ ব্যবস্থা কোনোটার সম্পর্কে জ্ঞান নেই। বাংলাদেশে এখনও প্রায় চার কোটি মানুষ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে আছেন অর্থাৎ তাদের কোনো একাউন্ট নেই। কিছুকাল আগে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক হিসাব চালু করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো, তা ছিলো মূলত কৃষকদের জন্য। গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে প্রায় ১ কোটি ৫৩ লক্ষ ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছিলো। এ সব হিসাবের বিপরীতে আদায় করা হয়েছে প্রায় ১৪ শত কোটি টাকা। কিন্তু এই হিসাবধারী গরিব, মজদুর ও অসহায় কৃষকদেরকে মাত্র ৫৩ কোটি টাকা লোন দেয়া হয়েছে। যে দেড় কোটি লোক ১০ টাকা দিয়ে একাউন্ট খুলেছে তারা Dorment হয়ে আছে। তাঁরাসহ প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। তাই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য আরো ব্যাংক গড়ে তোলা দরকার।
কিন্তু সতর্কতার বিষয় হলো অতীতের মত আরো Schedule Commerce ces প্রয়োজনীয়তা নেই। সেক্টরভিত্তিক বিশেষায়িত ব্যাপক পরিন করতে হবে। চলমান ব্যাংকিং কার্যক্রমে যা হচ্ছে তা হলো, কোটি কোটি গরিব, দারিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা এনে, তা সেয়া হচ্ছে বা বিনিয়োগ করা হচ্ছে কয়েক শত পরিবারের যাবে। অর্থাৎ মোট ব্যাংকিং বিনিয়োগের প্রায় ৮০ ভাগ অর্থ যাচ্ছে দেশের ১০ ভাগ মানুষের কাছে। বাকি ২০ ভাগ অর্থ পাচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ। লোন হিসেবে বিনিয়োগের অর্থ যদি দারিদ্র নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নারী উদ্যোক্তাদের হাতে যেত উন্নয়ন চারগুণ বৃদ্ধি পেতো। বর্তমান ব্যবস্থায় দেশের উন্নয়ন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। গরিববান্ধব অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে দেশ এতো দিনে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতো এবং ২০৪১ কেন ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে পারতো।
গরিবের ভাগ্য ফেরানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর দিকনিদের্শনা বাস্তবায়নের জন্য দেশের গরিব, মজুর, চাষা, কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নারী, শিশু, দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী, উপজাতি ইত্যাদি স্তরের মানুষের নিকটে অর্থনীতির সুবিধা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে বিশেষায়িত ব্যাংক গঠন করা প্রয়োজন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭৩ সালে কৃষকেরব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক গঠন করা হয়। এর পরে ১৯৮৬ সালে গঠিত এক অধ্যাদেশের বলে ১৯৮৭ সালে রাজশাহী বিভাগের কৃষকদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক গঠন করা হয়। কেন করা হয়, ঐ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক বিনিয়োগে বেশি নজর দেয়ার জন্য। এখন ঐ এলাকার শিল্প উন্নয়নেও ব্যাংকটি ভূমিকা রাখছে। এরকম প্রত্যেক বিভাগে নতুন করে কৃষি ও ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প উন্নয়নের জন্য একটি করে বিশেষায়িত ব্যাংক হতে পারে। কৃষির পাশাপাশি তারা এসএমই ব্যাংকিং করবে।
এসব অঞ্চলে এনজিও, ও সমবায় সমিতিসহ নানা প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে লেনদেন করছে। বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তায়ও তারা বিনিয়োগ করছে। দীর্ঘকাল ধরে তারা ব্যাংকিং জগতের বাইরে আরেকটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। তা হলে কেন ব্যাংক পারবে না সেখানে নতুন করে বিনিয়োগ কাঠামো গড়ে তুলতে। সেই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ এসব ব্যাংক থেকে সুবিধা নিতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন ব্যাংক নামে বিশেষায়িত ব্যাংক হতে পারে। এই ব্যাংক কেবল ঐ অঞ্চলে কাজ করবে।
এভাবে কমপক্ষে আরো ১০টি বিশেষায়িত ব্যাংক হতে পারে। এর কোনোটির কার্যক্রম চলমান ৫৭টি ব্যাং-ে কর সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। এগুলো সক্রিয় তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংক হবে না, এর কাঠামো ও বিনিয়োগের ধরন হবে ভিন্ন। বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আরও চার বা পাঁচ কোটি মানুষকে ব্যাংকিং channel এ নিয়ে আসা নিশ্চয়ই ওদের শেষ সম্বলটুকু লুট করার জন্য নয়, বরং তাদের কাছে ঋণের প্রবাহ পাঠাবার জন্য, যেন তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অধিকারটা তারা পেয়ে যায়। আমি বিনিয়োগ করার কথা বলছি। তা না হলে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।
আমাদের দেশে ট্যুরিজম শিল্পকে ঘিরে অর্থাৎ এই ইন্ডাস্ট্রি বিকাশের জন্য কোন বিশেষায়িত ব্যাংক নাই। এ সেক্টরে তেমন বিনিয়োগও হচ্ছে না। আমরা যদি ট্যুরিজম কেন্দ্রীক ব্যাংকিং সেবা চালু করতে পারি তাহলে ট্যুরিজম সেক্টর আরো সমৃদ্ধ হবে। পর্যটন খাতকে উন্নত করতে হলে পর্যটকদেরকে বিনিয়োগ সহায়তা দিতে হবে। কক্সবাজারে যেসব ব্যাংকের শাখা আছে তাদের কর্মকর্তাগণ পর্যটন খাতে বিনিয়োগের ধরন, কারা পর্যটক, পর্যটন খাতের প্রকারভেদ ইত্যাদি বুঝে বলে আমার মনে হয় না। হিল ট্যুরিজম, সী-ট্যুরিজম ও প্রত্নতাত্ত্বিক ট্যুরিজম এইভাবে পর্যটনকে বিন্যাস করা সম্ভব। এসব খাতের পর্যটক ঝিন্ন। কারণ সমুদ্রপ্রেমী আর পাহাড়প্রেমী এক নয়। এদেশের মানুষ প্রকৃতি প্রেমী, তাদেরকে যদি ঋণ সুবিধা দেয়া যেত তাহলে বহু মানুষ বছরে অন্তত দুইবার ভ্রমনের আনন্দ উপভোগ করার পরিকল্পনা করতো। বিনিয়োগ করার মাধ্যমে পর্যটন সেক্টর সমৃদ্ধ হতো।
দেশে ট্যুরিজম DEV ব্যাংক গঠন করা সম্ভব। দেশে যদি অনেক শ্রেণি পেশার জন্য ব্যাংক হতে পারে, যদি পুলিশ ব্যাংক হতে পারে, আনসার-ভিডিপি ব্যাংক হতে পারে, সেনাকল্যাণ সংস্থার ব্যাংক হতে পারে, বিজিবি'র জন্য সীমান্ত ব্যাংক হতে পারে, তাহলে পর্যটন খাতের জন্য পর্যটন উন্নয়ন ব্যাংক হতে পারবে না কেন? ৫৭টি তফসিলি ব্যাংক যখন কক্সবাজারে বিনিয়োগ করছে তারা কিন্তু ট্যুরিজমের ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই বুঝে না। তাদের সিজন বুঝার প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে না। কারণ তারা পর্যটককে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে না। ঋণ দিচ্ছে অবকাঠামো বা আমদানি রপ্তানি বা কোনো শিল্প ক্ষেত্রে। দেখুন, হাজার হাজার কোটি টাকা পর্যটকরা ব্যয় করে কিন্তু এর সাথে ব্যাংকের কোনো কার্যক্রম জড়িত নেই। এজন্য Tourism Devel- opment Bank স্থাপন করে Tourism Project বাড়াতে হবে, নান্দনিকতা সৃষ্টি করতে হবে এই খাতের diversification ঘটাতে ঋণ দিতে হবে। এজন্য ট্যুরিজম খাতের ব্যাংকিং বুঝতে হবে। এ ধরনের ব্যাংক ও ব্যাংকার না থাকার কারণে পর্যটন খাতের বিনিয়োগ ফেরত আসে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিকস রিসার্চ (এনবিইআর)।