মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

আবুল কালাম আজাদ’র ছোট গল্প ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’

শুক্রবার, মার্চ ৫, ২০২১
আবুল কালাম আজাদ’র ছোট গল্প ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’

আবুল কালাম আজাদ’র ছোট গল্প ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’ 

সোনালী সময় চলে যায় অনাদরে-অবহেলায়। চলে যায় বড্ড তড়াহুরোয়। সোনালী সময় অতিক্রম করে আমরা এখন পাথর সময়ে দাঁড়িয়ে। 

বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। সরকারি কোয়ার্টারে থাকার মেয়াদ শেষ। আমি এম.এ পাস করে চাকরি খুঁজছি দুই বছর। চাকরির জন্য দরখাস্ত করি। পরীক্ষা দেই। সবগুলো পরীক্ষা সমান ভালো না হলেও কোনো কোনো পরীক্ষা খুবই ভালো হয়। কিন্তু চাকরি হয় না। কেন হয় না তা জানি না। জানার সুযোগও নেই। টিউশনি করে কোনোমতে হাত খরচ চালাই। ছাত্র জীবন থেকেই এটা করে আসছি। 
শিলা আপা এম.এ পাস করেছে তামার চেয়ে দুই বছর আগে। চাকরি খুঁজছে চার বছর ধরে। আর বাবা-মা ওর জন্য একটা সুপাত্র খুঁজছেন তারও অনেক আগে থেকে। না চাকরি, না সুপাত্র কোনোটাই ওকে ধরা দিচ্ছে না।  

আর ছোট ভাই-বোন দুটো স্কুল-কলেজে।     
এই শহরে আমাদের নিজের বলে কিছু নেই। বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতো সাধ্য নেই। রোজগার বলতে তো বাবার পেনশন। আামাদের ফিরে যাওয়া সেই পল্লী মায়ের কমল-কোমল বুকে। যে গ্রাম ছেড়ে একদিন আমরা হৈ-হুল্লোর করে উঠে এসেছিলাম এই শহরে। ইট-পাথরের শহর আমাদের ছুড়ে ফেলে দিল। জানি, পল্লী জননী আমাদের ফেলবে না। সে তো বরাবর ডেকেই যায়-‘ফিরে আয়, ফিরে আয়।’ পরম আদোরে আবার বুকে টেনে নেবে। শব্দহীন কন্ঠে নিশ্চয় বলবে-‘আমি তো আছি।’ 

শিলা আপা এসে বলল: কিরে, এভাবে থম মেরে বসে আছিস যে? কাল সকালেই তো রওয়ানা হতে হবে। সব বাঁধা-টাধা শেষ করতে হবে না?

আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। গেলাম বইয়ের আলমারির কাছে। প্রথমে বইগুলো বাঁধতে হবে। অন্যান্য জিনিস বাঁধাছাদা করার জন্য সবাই আছে। এই বইগুলো বয়ে নেবার জন্য আছি শুধু আমি। বাবা তো সেদিন বলেই ফেললেন: পুরনো বইয়ের মার্কেটে গিয়ে ওসব তো হাফ দামে বিক্রি করে দিলেই পারিস। কেন ওসব কষ্ট করে গ্রামে বয়ে নেয়া? 

কোথাও হতে দু’টো পয়সা এলেই বাবার জন্য ভালো। কিন্তু আমি তো জানি, কত কষ্ট করে, তিল তিল করে আমি এই বইগুলো সংগ্রহ করেছি। ভীষণ দরকার থাকা সত্বেও একটা জামা না কিনে, সে পয়সা দিয়ে আমি কিনেছি দু’টো বই। আমার নিঃসঙ্গ ও ব্যর্থ (আপাতত নিজেকে আমি তাই মনে করি) জীবনের একমাত্র আনন্দ এইসব বই। 

আলমারির সবচেয়ে ওপরের তাকের কয়েকটা বই ধরে টান দিতেই ধপ করে একটা শক্ত বই একেবারে আমার ঘাড়ের ওপর পড়ল। তুলে নিয়ে দেখলাম, সেটা বই না। একটা ডায়েরি। নীল মলাটের ডায়েরি। আমার ভুরু কুঁচকে গেল। আমি মাঝে মাঝে গল্প অথবা কবিতা লেখার চেষ্টা করি। মনে রাখার মতো ছোট-বড় ঘটনাও টুকে রাখার অভ্যাস আছে আমার। তাই ডায়েরি ব্যবহার করি। কিন্তু এরকম ডায়েরি আমার কখনোই ছিল না। এটা এল কোত্থেকে?

হাতে নিয়ে এপিঠ-ওপিঠ উল্টে দেখলাম। না, ডায়েরিটা আমার না। ডাকলাম শিলা আপাকে। তিন ডাকের পর শিলা আপা এল। তার চোখে-মুখে বিরক্তি। কাজের সময় ডাকাডাকি করলে বিরক্তি তো আসবেই। ডায়েরিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম: এটা কি তোমার? 

শিলা আপা হাতে নিয়ে ত্রিশ সেকেন্ড দেখল। তারপর এক বর্ণের একটা মাত্র শব্দ ‘না’ উচ্চারণ করেই তার কাজে ফিরে গেল। 

আমি ডায়েরির ভেতরের পৃষ্ঠা উল্টালাম। গোটা গোটা অক্ষরে গল্প না কি যেন লেখা। আমি পড়তে শুরু করলাম। এক পৃষ্ঠা পড়তেই আমার সবকিছু মনে পড়ে গেল। 
ডায়েরিটা বন্যার। কয়েক বছর আগে ডায়েরিটা ও আমাকে দিয়েছিল। আমিও খুব আগ্রহের সাথে এনেছিলাম। ডায়েরিটা আনার সময় পড়বো বলে কথাও দিয়েছিলাম। কিছু কিছু কথা শুধু কথার কথাই হয়ে থাকে। তাই কাউকে কোনো কথা দেয়ার সময় ভেবেচিন্তে দেয়া উচিত।

বন্যারা আমাদের নিচের পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটে থাকতো। ওর বাবা চাকরির দিক থেকে আমার বাবার চেয়ে কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। বন্যাও আমার থেকে বছর তিনেকের সিনিয়র ছিল। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক ছিল ‘আপনি’। আমি বয়সে বন্যার চেয়ে জুনিয়র হলেও কখনো আমাকে ‘তুমি’ করে সম্বোধন করতে বলিনি। 

আমরা শৈশব থেকেই ওপর-নিচ প্রতিবেশি ছিলাম। তাই বলে প্রথম থেকেই যে আমাদের ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল তা নয়। তবে একটা সময় আমাদের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয় তা মানতেই হবে।
যাতাযাতের পথে প্রায়ই আমাদের দেখা হয়ে যেত। হয়তো আমি সিঁড়ি দিয়ে নামছি, বন্যা দাঁড়িয়ে আছে ওদের ঘরের দরজার সামনে। হয়তো আমি উঠছি, বন্যা নামছে। দেখা হয়ে গেল মাঝামাঝি সিঁড়িতে। 

দেখা হলেই বন্যা মিষ্টি করে হেসে দিয়ে বলতো: কেমন আছেন? 
আমি ওর মতো মিষ্টি করে হাসতে পারতাম না। তারপরও ঠোঁটে হাসি টেনেই উত্তর দিতাম।

বন্যা ছিল মাঝারি গড়নের শ্যামলা মেয়ে। রেশমি চুলগুলো বেশিরভাগ সময় অবিন্যস্ত থাকতো। সব সময় কয়েকগুচ্ছ চুল ওর মুখ ঢেকে রাখতো। কথা বলার সময় বার বার চুলগুচ্ছ মুখ থেকে সরাতো। কখনও বাঁ হাতে চুলগুচ্ছকে গোলাপগুচ্ছের মতো ধরে রেখে কথা বলতো। হাসলে ওর দুই গালে টোল পড়তো। এক গালে টোল পড়া মেয়ে অনেক দেখেছি। দুই গালে টোল পড়া মেয়ে দেখলাম শুধু বন্যাকে। গালে টোল পড়া মেয়েরা নাকি দুঃখি হয়। কিন্তু কেন জানি গালে টোল পড়া মেয়েদের আমার ভালো লাগতো। ওরা দুঃখি হয় বলেই হয়তো। দুই গালে টোল পড়া মেয়েরা কি আরও বেশি দুঃখি হয়? তবে বন্যার চোখে-মুখে-মুখের কথায়-হাসিতে কোথাও কখনও দুঃখের চিহ্নমাত্র দেখিনি। ওর মুখের সাথে হাসিটা ভীষণ মানানো ছিল। 
একদিন।

আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। বন্যার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। ও চিরায়িত মিষ্টি হাসি হেসে ঘাড়টা ডানদিকে একটু কাৎ করে বলল: কেমন আছেন?
: হু, ভালো। 
: কোথা থেকে ফিরলেন?
: টিউশনি থেকে।
: আবার কোনো তাড়া আছে?
: না, আজ আর বিশেষ কোনো তাড়া নেই। 
: তাহলে আসুন, বেলকুনীতে একটু দাঁড়াই। একটু কথা বলি। আজ কেন যেন নিজেকে খুব একা লাগছে। মনে হচ্ছে, কারও সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভালো লাগতো। আপনিই সেই উপযুক্ত জন।

: আমি! হাহাহা।
আমরা বেলকুনীতে দাঁড়ালাম। পাশাপাশি। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে আমি দূরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু কী নিয়ে কথা বলবো তা-ই বুঝতে পারছিলাম না। এর আগে বন্যার সাথে আমার কখনোই গল্প হয়নি। 
বন্যা বলল: গতকাল পত্রিকায় আপনার গল্প পড়লাম।

: আমার......! আমি চমকে উঠলাম। আমি যে একটু-আধটু লিখি, এবং মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা আসে তা তো ওর জানার কথা না। এ ব্যাপারটা আমি কারও কাছেই প্রকাশ করতে চাই না। আমার নামে তো কত মানুষই আছে। বন্যা বুঝলো কেমন করে যে, ওটা আমার লেখা গল্প? নিশ্চয় শিলা আপা কিছু বলেছে। শিলা আপার মুখে শুধু আমার প্রশংসা। 
চমকানোর পালা শেষ হলে বললাম: নিশ্চয় ভালো লাগেনি?

বন্যা বলল: ‘চমৎকার হয়েছে’ এরকম মিথ্যা তারিফ করবো না। বলবো, মন্দ হয়নি। লেগে থাকলে হবে। আপনার ভেতর সে যোগ্যতা আছে।
: জাস্ট অবসর সময়টার সদ্ব্যহারের জন্য একটু লেখার চেষ্টা করি। আড্ডাবাজ হতে পারিনি বলে বন্ধুদের আড্ডায় যাই না খুব একটা।
: এভাবেই অনেকে শেষ পর্যন্ত লেখক হয়ে উঠেছেন। 

তারপর থেকে মাঝে মাঝেই ওঠা-নামার পথে বন্যার সাথে আমার কথা হতো। কখনো দু’/চার মিনিট। কখনো আরও বেশি। 
আস্তে আস্তে কথা বলার সময়ের পরিধি বাড়তে লাগলো। আমি মানুষটা একটু অন্যরকম। নিজের সম্পর্কে আগ বাড়িয়ে কিছু বলি না। অন্যের সম্পর্কেও বিশেষ আগ্রহ দেখাই না। কিন্তু আমি বুঝি, যে লেখালেখি করে তার মানসিকতা এমনটি হওয়া উচিত না। একজন লেখকের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহ থাকা উচিত।
তবে বন্যা ছিল আমার বিপরীত। গল্প করতে গেলেই সে আমার সম্পর্কে এটা-ওটা প্রশ্ন করতো। 
একদিন বলল: আপনি পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি করেন, টিউশনিও......।
: টিউশনিটা করি প্রয়োজনে। 

: তবু...., সবার তো সে ধৈর্য্য থাকে না। আপনি পড়ান এরকম দু/চারজন ছেলেমেয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওরা বলল, বেশ ভালো পড়ান। বিশেষ করে ইংরেজি গ্রামারটা খুব প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দেন।
: হাহাহা। বেশ রিপোর্টার হয়েছেন দেখছি। 
: আর কিছু কি করেন?
আমি একটু খাবি খেয়ে গেলাম যেন। বাস্তবিক খাবি খাওয়ার মত প্রশ্ন বন্যা করেনি। আমি শিল্পের আরও একটা মাধ্যমের সাথে যুক্ত আছি। এমনিতেই বন্যা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাই সেই জড়িত থাকার কথা জানাতে ইচ্ছা নেই। 

বন্যা বলল: করেন আরও কিছু?
সব দ্বিধা ঝেরে ফেলে বললাম: আমি একটা আবৃত্তি সংগঠনের সাথে যুক্ত আছি। আবৃত্তি চর্চা করছি। 
: বাব্বাহ! পারেন কীভাবে এতকিছু?
এই বিস্ময়, এই প্রশ্নের বিপক্ষে একটা রক্তিম হাসি হাসা ছাড়া আমার আর কিছুই বলার ছিল না। বন্যা বলল: আবৃত্তি শোনাতে হবে এখন?
: এখন!
: হু, সমস্যার কিছু নেই। যারা গান করে তাদেরকে গান শোনানোর অনুরোধ করলে অজুহাত তোলে, ইনস্ট্রুমেন্ট ছাড়া খালি গলায় গাওয়ার অভ্যাস নেই। কিন্তু আবৃত্তির ক্ষেত্রে এরকম অজুহাত খাটে না। 

: আচ্ছা, অন্য একদিন......।
: না না, আমি নাছোরবান্দা। ছোট্ট একটা কবিতা হলেও শোনাতে হবে। 
নাছোরবান্দাকে এড়িয়ে যাবার সাধ্য কার? আমি শক্তি চট্টপাধ্যায়ের খুবই ছোট একটা কবিতা ‘কিছু মায়া রয়ে গেল’ আবৃত্তি করলাম। বিশেষ কোনো কারণ নির্ধারণ করে এই কবিতা আবৃত্তি করিনি। বেশি বড় কবিতার মধ্যে যেতে চাচ্ছিলাম না। ছোট’র মধ্যে চট করে এটাই মনে এল। 
আবৃত্তি শেষ হতেই বন্যা খুব বড় একটা প্রশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ কি সে শ্বাস আটকে রেখেছিল? তারপর বলল: গল্প পড়ে ‘অসাধারণ’ বলতে পারিনি, কিন্তু আবৃত্তি শুনে সত্যিই বলতে হচ্ছে-অসাধারণ!
আমি বললাম: ধন্যবাদ। 
: আপনি প্রতিভাবান মানুষ।
: শুধু আপনার কাছে। 
: তা নয়, যে আপনাকে জানবে সে-ই একথা বলতে বাধ্য হবে। 

আরেকদিন 
আরেকদিন আমি সিঁড়ি বেয়ে নামছিলাম। দোতালায় এসে পা আটকে গেল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। কান পাতলাম। গান ভেসে আসছে। খালি গলার গান। রবীন্দ্র সংগীত-
এ মণহিার আমায় নাহি সাজ-ে-
কে গান গাইছে? বন্যা? ওদের ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল না। শুধু ভেজানো ছিল। আমি নিতান্তই আনকালচার্ড-এর মত দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঢুকতেই বন্যার সাথে চোখাচোখি হল। অমনি বন্যা গান থামিয়ে দিল। আমি আফসোস করলাম-যদি ঘরে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতাম........!
বন্যা বলল: আসুন, আসুন। 
গিয়ে বসলাম বন্যার মুখোমুখি একটা সিঙ্গেল সোফায়। বন্যা বলল: আপনি যে আমাদের বাসায় কখনো আসবেন তা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। 

: এটা কারও ভাবনার বিষয়ও হতে পারে না।
: কী খাবেন?
: খেতে এসেছি ভাবছেন?
: হিহিহি, তা নয়। এসেছেন যখন......।
: আমি কিছু খেতে চাই না। আমার শ্রবণ ইন্দ্রিয় কিছু উপভোগ করতে চায়, ললিত কন্ঠের সংগীত.....। 
: হিহিহি। 

বন্যার মা এলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। শুধুই দাঁড়ালাম। কোনো সম্বোধন করলাম না। এত অভদ্র কেন আমি?
তিনি বললেন: বসো বাবা, বসো। ওপর-নিচ ফ্ল্যাটে থাকি। মাঝে মাঝে আসতে পারো। কিন্তু.....।
বন্যা বলল: মা, তাকে আসতে বলো না। যে ব্যস্ত মানুষ!
বন্যার কথায় কান না দিয়ে বন্যার মা বললেন: তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?
: জি ভালো। আপনার শরীর ভালো তো?
: বয়স হয়েছে। মাঝে মাঝে একটু বিগড়ে যায়। 
: সাবধানে থাকবেন। এ বয়সে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। 
: তোমরা কথা বলো। আমি চা নিয়ে আসছি। 
: না না, খালাম্মা.....। 
: ‘না’ বলবে না। এই প্রথম এসেছো। 

বন্যার মা চলে গেলেন। আমি বললাম: এসেছি যখন গান শুনে যাব। 
বন্যা কিছু বলল না। মুচকি হাসলো। আমি বললাম: আপনিও যেমন নাছোরবান্দা, আমিও তেমন। কোনো অজুহাত মানবো না। 
বন্যা গাইলো:
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে........
একদিন আমার আবৃত্তি শুনে বন্যা দীর্ঘ একটা প্রশ্বাস ত্যাগ করেছিল। আমি তার চেয়েও দীর্ঘ একটা প্রশ্বাস ত্যাগ করলাম। 
বন্যার মা চা-নাস্তা নিয়ে এলেন। আমি বললাম: খালাম্মা, শুধু চা দিলেই হতো।
: খাও বাবা, তেমন কিছু তো দেইনি। তিনি চলে গেলেন। 
আমি একটা আঙুর মুখে দিয়ে বললাম: আমি কিন্তু মাঝে মাঝে আসবো।
: আসবেন, মারবো না। আর কিছু না হোক, এক কাপ চা তো খাওয়াতে পারবো। 
: চা খেতে নয়। আসবো গান শুনতে। 
: অদ্ভূত মানুষ আপনি।
: অদ্ভূত নয়। আমি গান বুঝি। আপনার কন্ঠ এবং সুরের ওপর দক্ষতা আমাকে বিমোহিত করেছে। 
: যা বলেন!
: শিখতে পারতেন।
: এক সময় চর্চা করতামা। কেন যেন বন্ধ হয়ে গেল। 
পাশে তাকিয়ে ছোট্ট দু’টো টেবিলে হারমোনিয়াম-তবল দেখলাম। চর্চা করতেন বুঝলাম। বললাম: চর্চাটা থামিয়ে দিয়ে দেশের ক্ষতি করলেন। দেশ একজন ভালো রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী পেতে আশা করেছিল, তাতে আপনার খুব হিংসা হলো। 
: হিহিহি.....। আপনি যা বলেন!
: তাহলে আজ উঠি।
: আসবেন কিন্তু মাঝে মাঝে। কথা দিয়েছেন। 
: আসতেই হবে। 
তারপর থেকে মাঝে মাঝেই বন্যার ওখানে যেতাম। চা-নাস্তা। গল্প। গান শোনা। বিনিময়ে আবৃত্তি শোনানো।
একদিন বন্যা নীল মলাটের একটা ডায়েরি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সঙ্কোচমাখা কন্ঠে বলল: সময় পেলে একবার পড়ে দেখবেন, কিছু হয়েছে কি না। 
: কী, গল্প না কবিতা?
: পড়ে দেখবেন। 
: অবশ্যই, যদি সেরকম মনে করি তাহলে আপনার নাম-ঠিকানা দিয়ে কোনো সম্পাদকের দপ্তরে পৌছে দেব কি?
: না না! সেরকম কিছু করার দরকার নেই। 

ডায়েরিটা এনে আমি গুঁজে রাখলাম আলমারির প্রথম তাকটায়। পড়ার সময় হলো না, তা বলবো না। পড়ার কথা মনেই থাকল না। কিন্তু বন্যা আর আমাকে ডায়েরি সম্পর্কে কখনও একটা কথাও বলেনি। হয়তো ভেবেছে, আমি পড়েছি। ভালো লাগেনি। এ কথা সরাসরি বলতে কুন্ঠা বোধ করছি বলে এড়িয়ে যাচ্ছি। 
বছর তিনেক আগে বন্যার বাবা রিটায়ার্ট করলেন। ওর এক ভাই জার্মানী থাকে। ওরা শহরের এক প্রান্তে সিমসাম দোতালা একটা বাড়ি করেছে। ওদের পরিবার উঠে গেল সেই বাড়িতে। 
কিন্তু বন্যা সেই সেই সুন্দর-সিমসাম বাড়িটায় যেতে পারেনি। কোথায় গেছে বন্যা? শ্বশুড়বাড়ি?

আমার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। সত্যিই অনেক ব্যস্ত। রাত জেগে পড়ি। সকালে যাই পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা দিয়ে ফিরে দুপুরের পর একটু ঘুমিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করি রাতে পড়ার জন্য। কোথাও যাওয়ার সময় নেই। কোনো কিছু ভাবার ফুরসত নেই। পরীক্ষার মাঝে দুই/একদিন গ্যাপ থাকলে সে সময়টাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। 
সেদিন ছিল গ্যাপ ডে। সকাল নয়টা বেজে গেছে। সূর্যের আলো এসে লুটোপুটি যাচ্ছে আমার বিছানায়। তাতে আমার ঘুমে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। আমি দিব্যি ঘুমাচ্ছি।
মা এসে আমাকে ধাক্কা দিতে লাগলেন। আমি একটুখানি চোখ খুলে, একটুখানি ঘাড় কাৎ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আরও জড়োসরো হয়ে শুলাম। কিন্তু মা’র ধাক্কা বিরতীহীন।
আশ্চার্য! মা-তো কখনো এমনটি করেন না। মা আমাকে স্বাধীনভাবে ঘুমাতে দেন। বাবার বিরক্তি ছিল খুব: এতবেলা পর্যন্ত কোনো ছেলে ঘুমায়? ‘আর্লি টু বেড এন্ড আর্লি টু রাইজ/ মেকস অ্যা ম্যান হেলদি, ওয়েলদি এনড ওয়াইজ’-এই প্রবাদটা হয়তো ও কোনোদিনও শোনেনি।

মা আমার পক্ষে বলতেন: রাত জেগে পড়ে যে। 
: কী পড়ে? পড়ে গল্প, কবিতা, উপন্যাস। কাজের পড়া তো কিছু পড়ে না। 
গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়া কাজের পড়া নয়। মা এর বিপক্ষে বিশেষ যুক্তি দেখাতে পারেন না, অথবা দেখাতে চান না। বাবার সাথে কলহ এড়িয়ে চলাই মা’র সারা জীবনের প্রচেষ্টা। 
সেই মা এখন আমাকে প্রবল ধাক্কা দিচ্ছেন। বাসায় কি ডাকাত পড়েছে? অবশেষে আমি উঠে বসলাম। ঘুম জড়ানো চোখে মায়ের মুখে তাকালাম। চোখ কোচলালাম। হাই তুললাম। আড়মোড় ভাঙলাম। মা কিছু বলেন না। শুধু আঙুল তুলে জানালার নিচে কি যেন নির্দেশ করেন। কী দেখাতে চান মা? আমি বললাম: কী.....?
মা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কিছু বলেন না। শুধুই জানালায় নির্দেশ করেন। 
আমি জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম। একটা কফিন নামানো। অনেক মানুষ।
আমি বললাম: কে মারা গেছে মা?
: বন্যা।
: বন্যা! কি বলছো মা! আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। 

মা বললেন: হ্যাঁ। 
: কী হয়েছিল? কিছুই তো জানলাম না! 
: অনেকদিন ধরেই তো পেটে ব্যাথা ছিল। এ ডাক্তার-সে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। পনেরোদিন আগে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ধরা পড়ে, লিভার ড্যামেজ। কিছুই করা গেল না আর। 
: একবার জানলামও না।
: আমি তো ভেবেছি, তুই জানিস।
: নাহ! ওদের কেউ আমাকে কিচ্ছু বলেনি।
: হয়তো তোর সাথে ওদের কারও দেখা হয়নি।
: ওর ছোট ভাইয়ের সাথে দুই/একবার দেখা হয়েছিল।
: ওদের খুব অস্থির সময় কাটছিল কি না।  র্
তারপর আমি নিচে নেমে গেলাম। বন্যার মুখ দেখলাম। বড্ড হলুদ! বড্ড অচেনা!
শুধু গোসলের সময়টা বাদ দিয়ে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আমি বন্যার খুব কাছে ছিলাম। খুব কাছে। এই তো শেষ। আর তো কখনোই বন্যার পাশে বা মুখোমুখি বসা হবে না, দাঁড়ানো হবে না। ভেতরে বন্যার মা ডাক চিৎকার করছেন। বন্যার বাবা একবার বাইরে আসছেন, আবার ঘরে যাচ্ছেন। ছোট বোনটা কোনো এক কোণায় বসে কাঁদছে। ছোট ভাইটা ঘরের ভেতর বিক্ষিপ্ত ঘুরছে। বড়ো ভাই তো জার্মানীতে। খবর পেয়েছে কি না জানি না।  

একবার বন্যার বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন: বাবা, হাসপাতালে বন্যা অনেকবার তোমার কথা........। কিন্তু কী করবো বলো.......। মানে..... কোন দিকে যাই..... কি যে করি......। 
তিনি কোনো বাক্যই শেষ করতে পারলেন না। রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেলেন। বাস্তবিক তা ঘাম না। হয়তো তার সঞ্চিত সারা জীবনের কান্না। তিল তিল করে এই কান্না জমা করেছিলেন তিনি। সন্তানদের তিল তিল করে ভালোবাসা থেকে জমতে থাকে আনন্দ অথবা কান্না। যে বাবা-মা হতভাগ্য তাদের সেই কান্না ঝরিয়ে দিতে হয়।   
একবার বন্যার মা ঘর থেকে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমাকে জাপটে ধরে বন্যার বাবার অসমাপ্ত বাক্যগুলো আর্তচিৎকারে ঠিক ঠিক সমাপ্ত করলেন: বাবা! বন্যা বার বার তোমার কথা বলেছিল। তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। 

: আমাকে কেউ একটা খবর দিলেন না।
: ও যে এইভাবে ফাঁকি দেবে আমরা কি ভাবতে পারছিলাম বাবা!
কয়েকজন ধরে বন্যার মাকে ভেতরে নিয়ে গেল। 
শেষ বিকালে বন্যাকে নিয়ে যাওয়া হলো ওদের গ্রামের বাড়িতে। অনেকেই গেল সাথে। আমারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। পরদিন যে আমার পরীক্ষা। এটা হলো বেঁচে থাকার অবলম্বন। কারও মৃত্যু শোকে একে অবহেলা করা যাবে না!

রাতে ডায়েরিটা আরও একবার আগাগোড়া পড়লাম। তারপর ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। তখন শিলা আপা এল। আমার পাশে বসল। বলল: জানি, গ্রামে ফিরে যেতে তোর কষ্ট হচ্ছে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে শহরে উঠে এসেছিলি। তবে ভেঙে পড়িস না। আমার বিশ্বাস, তোর ভালো একটা চাকরি হবে-হবেই। তুই আবার শহরে ফিরে আসবি। আমার হয়তো গ্রামের ছোট কোনো ব্যবসায়ী অথবা কোনো স্কুল মাস্টারের সাথে বিয়ে হবে। স্কুল মাস্টারের সাথে বিয়ে হলে অখুশি হবো না। ব্যবসায়ীর সাথে আমার মিলবে না। আমরা শহরে তোর কাছে বেড়াতে আসবো। তুই ছেলে মানুষ। শক্ত হ’। 

আমি বললাম: আপা, তোমার কি বন্যার কথা মনে আছে?
: বন্যা! কেন মনে থাকবে না? শান্ত, মায়াময় একটা মেয়ে ছিল ও। কি চমৎকার গানের গলা ছিল! বয়সে ছিল আমার সমান। আমার সাথেই গ্রাজুয়েট শেষ করেছিল। অথচ এম.এ-তে আর ভর্তি হলো না। এম.এ-টা কেন করলো না জানি না। আমি এম.এ করেই বা কী করতে পারছি? যাহোক, আমার সাথে বন্ধুত্ব না হয়ে, ওর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তোর সাথে। তোরা ‘আপনি-আপনি’ করে কথা বলতি। তোর উচিত ছিল, ওকে ‘তুমি’ বলার অনুমতি দেয়া। 
: আপা, এই ডায়েরিটা বন্যার। আমি ডায়েরিটা শিলা আপার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। 
শিলা আপা বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলল: বন্যার! তোর কাছে এল কী করে?
: একদিন বন্যা আমাকে দিয়েছিল। 

: কেন? 
: পড়ে দেখার জন্য। পড়ে মন্তব্য করার জন্য। 
: নিশ্চয় পড়েছিলি না?
: ভুলে গিয়েছিলাম। 
: তুই তো চিরকালের ভুলোমনা। বলবো না যে, তুই বিশেষ অন্যায় করেছিস। ডৎড়হম রং ৎিরহম. তো এখন পড়ে দেখ।
: পড়েছি। 
: কী লিখেছে? কেমন লিখেছে? 
আমি শিলা আপার কথার জবাব না দিয়ে উঠে গেলাম। গিয়ে দাঁড়ালাম বারান্দায় জানালার পাশে। শিলা আপাও আমার পিছু হেঁটে এল। মুহূর্তকাল প্রায় আমার শরীর ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকল। কি বুঝল জানি না। তারপর একটু হেসে দিয়ে চলে গেল। 
আমার ভেতর না পাওয়ার একটা বেদনা ছিল যে, আমার জীবনে প্রেম এল না। ‘.....হৃদয় আছে যার, সেই তো ভালোবাসে/ প্রতিটি মানুষেরই জীবনে প্রেম আসে.....।’ প্রিয় গানটার এইটুকু শুনলে নিজেকে মানুষ ভাবতে কষ্ট হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভালোবাসা-বাসি দেখেছি। টিএসসির সিঁড়িতে, লবিতে, ঘাসে ঢাকা মাঠে, মধুর ক্যান্টিনে কত ভালোবাসা-বাসি দেখেছি! জোড়ায় জোড়ায়। হাতে হাত। চোখে চোখ। ঠোঁটে ঠোঁট।

আমি কি তৃষ্ণার্ত হইনি? কিন্তু মেটেনি তৃষ্ণা। আসেনি কেউ শীতল জলের কলস নিয়ে। একটা হাপিতাস আমার ভেতর তোলপার করেছে। 
কিন্তু বন্যার ডায়েরিটা পড়ার পড় আমার আর কোনো দুঃখবোধ থাকল না। প্রেমহীন জীবন আমারও নয়। খুব সঙ্গোপনে, খুব ধীর তালে, খু-উ-ব নিঃশব্দে একদিন প্রেম এসেছিল আমার জীবনে। 
তাকে অনুভব করার অনুভূতিই আমার ছিল না।

তাকালাম দূরের আকাশে। আকাশে জোছনার ফুল। জানালা থেকে চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা তারা দেখা যাচ্ছে। একটা মাত্র তারা। আশেপাশে খুব ভালো করে খুঁজলাম। না, আর কোনো তারা নেই। এরকম নিঃসঙ্গ একটা তারা আমি কোনোদিন দেখিনি। বন্যা কি এখন ঐ তারাটার মতোই নিঃসঙ্গ আছে? নাকি ঐ তারাটাই বন্যা? যদি তাই হয় তবে ও আমাকে দেখছে নিশ্চয়। কী ভাবছে আমাকে নিয়ে? ও কি জানে, আমি আজ কতটা নিঃসঙ্গ? 

পরিবারের সবার সাথে থেকেও আমি আজ কম নিঃসঙ্গ নই। একজন বেকার, ব্যর্থ যুবক কতটা নিঃসঙ্গ তা সবাই উপলব্ধি করতে পারে না।
মৃতের মতোই নিঃসঙ্গ একজন জীবিত ব্যর্থ, বেকার যুবক। মৃতরা কি নিঃসঙ্গ?              
   
সময় জার্নাল/আরইউ 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল