মুহাম্মদ মুসা খান:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ’র চিন্তা-চেতনা, ধ্যানধারণা এবং দেশ ও মানবতার কল্যাণে তাঁর দর্শন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকাশনা “এক পলকে একটু দেখা : অধ্যাপক পারভেজের জীবন ও দর্শন”। বইটি তাঁর জীবনাচার মৌলিক দর্শনের সংমিশ্রণ। এমন প্রকাশনা সচারাচর দেখা যায় না। সে হিসেবে এই গ্রন্থকে একটি ব্যতিক্রমী প্রকাশনা বলে আখ্যায়িত করা যায়।
প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজের জন্ম বেড়ে ওঠা ধনাঢ্য পরিবারে হলেও চিন্তা-চেতনায় তিনি একজন মানবিক মানুষ। দেশের দারিদ্র মানুষের দুর্দশা তাঁকে ব্যথিত করে। দুর্নীতির মহোৎসব দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হোন। সমাজের ধনী-গরীবের বৈষম্য তাঁকে বিচলিত করে। তিনি স্বপ্ন দেখেন দারিদ্র্যমুক্ত ও বৈষম্য মুক্ত এক বাংলাদেশের। যেমনটি স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রফেসর পারভেজ সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সাথে জড়িত রয়েছেন। তাছাড়া তিনি প্রশাসন ও আর্থিক সংস্থার শীর্ষ পদেও বেশ সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর রয়েছে - চমৎকার উপস্থাপনা, ব্যবস্থাপনা এবং আলোচনার দক্ষতা । তিনি ব্যাংকিং, বিনিয়োগ, অর্থনীতি ও ভূ-অর্থনৈতিক সম্পর্কের একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক। গরিবের জীবন ও অর্থনৈতিক মুক্তি, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, দুর্নীতি- সুশাসন, সুষম সমাজ, কর্পোরেট গভর্নেন্স, পাবলিক পলিসি, গতিশীল সরকার, ডিস্ট্রিবিউশন সাইন্স, পলিটিক্যাল ইকোনমি, অর্থশাস্ত্র ও বহুবিদ বিষয়ে ৫০টির অধিক গবেষণাধর্মি লেখা বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
“এক পলকে একটু দেখা:অধ্যাপক পারভেজের জীবন ও দর্শন” গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রথমেই সম্পাদক সাহেব প্রফেসর পারভেজ’'র মুখোমুখি হয়েবিভিন্ন বিষয় জানতে চেয়েছেন। মূলত: এর মাধ্যমে প্রফেসর পারভেজ’র মূল দর্শন সম্পর্কে আমরা অবহিত হতে পেরেছি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এমন এক দেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে নতুন প্রজন্ম আদরে বড় হবে, আর বয়স্করা থাকবে সমাদরে। সেখানে থাকবে না কোন হানাহানি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও রক্তের হোলি কলা খেলা, থাকবে না কোন দুর্নীতি, থাকবে না কোন সন্ত্রাস। তিনি অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্তের ‘বিকল্প সমাজের সন্ধানে’ গ্রন্থ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন । যে বিকল্প সমাজে প্রতিহিংসা ও শোষণ,-বঞ্চনা থাকবে না । তিনি বলেন, আমরা একটি অসম সমাজে বাস করছি আমাদেরকে সুষম সমাজ তৈরীর কথা ভাবতে হয়। ‘সুষম সমাজ গঠনে কতটা আশাবাদী’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শতভাগ ন্যায্য সমাজ হয়তো আমরা পাবো না, কিন্তু আমরা ‘ফেয়ার ওয়ার্ল্ডের’’ দিকে এগিয়ে যেতে চাই, এবং সব মানুষেরই সেটা চাওয়া উচিত। তিনি অমর্ত্য সেনের ‘নীতি ও ন্যায্যতা’ গ্রন্থ থেকেও কিছুটা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন । নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মানুষ যা পায় তা তার কর্মের ফসল। তিনি বলেন, সমাজ বৈষম্যহীন নয়, কিন্তু প্রকৃতি বৈষম্যহীন। প্রকৃতি কখনো বৈষম্য করে না। সুতরাং আমাদেরকে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকেও তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান।
‘উন্নয়নের ফর্মুলা অধ্যয়ে’ তিনি অমর্ত্য সেনের ‘উন্নয়ন তথ্য’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন । আলোচনা করেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথ্য নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি এখানে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো থিওরি প্রসঙ্গও টেনে আনেন। অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন তত্ত্ব আলোচনায় তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের স্বাধীনতা নেই, সেজন্যই তারা দরিদ্র। তিনি বলেন,শুধুমাত্র আয় বৃদ্ধি মানুষকে সুখী করে না। সুখী করার জন্য প্রয়োজন- সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাধীনতা ও কল্যাণ। অমর্ত্য সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেন, উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো- মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা.। সেই স্বাধীনতা হলো- খাদ্য,শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাক স্বাধীনতা। অভিজিৎ এর তত্ত্ব আলোচনায় তিনি তাঁর ও সংগিনী এস্থার ডাফলোর রচিত ‘পুওর বা ‘দরিদ্র অর্থনীতি’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, দরিদ্র অর্থনীতি ও দরিদ্রদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনীতি এক নয় । তিনি বলেন, দরিদ্রদের জীবন খুবই জটিল। দরিদ্র মানুষ সমাজে অনেক পিছিয়ে পড়ে তাঁদের বুঝানো হয়, তাঁরা অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে তারা অক্ষম নন। তাদের দাবিয়ে রাখা হয়। এবং শুধু অর্থ সাহায্য -দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র দূরীকরণ করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো থিওরি ( জিরো পোভার্টি, জিরো নেট কার্বন ইমিশন,জিরো আনএমপ্লমেন্ট) আগামী দিনের নিরাপদ বিশ্বের জন্য প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তরুনরা সবচেয়ে বড় শক্তি। তরুনরাই পৃথিবীর ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবে। সুশাসনকে তিনি মহাশক্তি বলেও উল্লেখ করেন। অমর্ত্য সেন ও প্রফেসর ইউনুসকে তিনি গোটা মানবজাতির সম্পদ বলে উল্লেখ করেন।
দারিদ্র বিমোচন ভাবনা অধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, অর্থাভাবই সমাজে উন্নয়নের মূল বাঁধা। অর্থের অভাবে মানুষ তাঁর মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এদেশের তৃণমূল মানুষের মাঝে অর্থ প্রবাহ সমন্বয় করা প্রয়োজন। তিনি দারিদ্র দূরীকরণে চারটি রোডম্যাপ দিয়েছেন। সেগুলো হলো- বেকারত্ব দূরীকরণ, কমিউনিটি সিস্টেমে আবাসন প্রকল্প, গণমুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বিতরণ। দারিদ্র দূরীকরণে কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই -বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ‘প্রতিবছর শিক্ষিত বেকার বাড়ছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
‘সুষম সমাজের ধারণা’ অধ্যায়ে তিনি তাঁর স্বপ্নের ‘সুষম সমাজের’ বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি বলেন, বিগত ৫০ বছরে দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠেছে এটা সত্য, কিন্তু এর মধ্যে ধনী ও দারিদ্র্যের বৈষম্য ও ব্যবধানও বেড়েছে। এ বৈষম্য কমাতে না পারলে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব হবে না। তিনি ‘বেকারত্বকে’ সুষম সমাজের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেন এবং মন্তব্য করেন যে, বেকারত্ব না থাকলে অন্ন- বস্ত্র-চিকিৎসায়-শিক্ষা ও আবাসনের কোন অভাব থাকবে না। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যদি সুষমা সমাজ তৈরি করতে পারে তাহলে আমরাও পারব, তবে এরজন্য সংকল্প প্রয়োজন। সুষম সমাজ বিনির্মাণে আশু কিছু করণীয়ের কথা তিনি উল্লেখ করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বেকারত্ব দূর করা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষাঋণ চালু করা, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, ভ্রাম্যমান আদালত প্রতিষ্ঠা, প্রতারণা প্রতিরোধ, অপরাধীদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন না দেওয়া, ওষুধনীতির বাস্তবায়ন করা।
‘সুষম সমাজ গড়ার রুপরেখা’ অধ্যায়ে তিনি বলেন, শত শত বছর পরাধীনতার পর অনেক ত্যাগের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এখনো আসেনি। তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন- লাগসই কর্মসূচি। সুষমা সমাজ হবে বেকারত্বহীন, দারিদ্র্যমুক্ত, অবক্ষয়হীন, অর্থনীতিকভাবে সমৃদ্ধ এক সমাজ। তার স্বপ্নের সুষম সমাজে তিনি নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের উপর জোর দেন। তিনি মনে করেন, নারীর ক্ষমতায়ন বাড়লে- নারী নির্যাতন কমবে, নারীর নিরাপত্তা বাড়বে এবং সংসার ও সমাজের সমৃদ্ধি আসবে। তিনি প্রবাসীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণের কথাও তাঁর রচনায় উল্লেখ করেন। তুমি বলেন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করে। অথচ বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা তাঁদের যথাযথ সম্মান দিতে পারি না, যা খুবই দুঃখজনক তিনি পরিবর্তন কামনা করেন।
তিনি তাঁর সুষম সমাজে সুচিকিৎসার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যক ‘নার্সিং ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি দেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার চার্জ কমানোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার জন্য এবং ভেজাল ওষুধ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে আহ্বান জানান।
‘আলোচ্য বইয়ের’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল ‘প্রফেসর পারভেজের সুশাসন ভাবনা’ । যেখানে তিনি সুশাসনের জন্য দেশের সর্বপ্রথম ‘নাইন আই মডেল’ এর প্রস্তাব করেন । তিনি মনে করেন, এ ‘নাইন আই মডেল’ বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে । এই ‘নাইন আই মডেল’ একটি আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা বলে আমরা মনে করি। কারণ সরকারের বিভিন্ন অর্গান গুলো স্বাধীন ভাবে (ইন্ডিপেন্ডেটলি) কাজ করতে না পারে, তখন উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্থ হয়। সুতরাং আমরা মনে করি, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই বইয়ে প্রস্তাবিত ‘নাইন আই মডেল’ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে তিনি ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠায়’ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নেওয়া আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ব্যক্তি শাসনের চেয়ে আইনের শাসনই সর্বোত্তম। এবং জনগণ কেন্দ্রিক শাসন -সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন। তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সুশাসনের ধারণা-এই বইয়ে সন্নিবেশ করেন। যা বইয়ের গুণগত মানকে অনেক বৃদ্ধি করেছে । তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সংসদ সদস্য, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, প্রচার মাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দূদক, নির্বাচন কমিশন, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন স্বতন্ত্র স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকাও বইতে তুলে ধরেছেন। তাছাড়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আরো কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো হলো- সরকারি সম্পদের অপচয় বন্ধ করা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করা, সম্পদের সুষম বন্টন, প্রত্যেক নাগরিকের ঋণ পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন সমন্বয়, নিয়োগ বান্ধব পরিবেশ ইত্যাদি।
এতসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা-বইটিকে অনন্য মর্যাদা দান করেছে। কারণ এত বিশদ পর্যালোচনা আর কোন বইয়ে ইতোপূর্বে দেখা যায়নি।
প্রফেসর পারভেজ- এই বইয়ে দেশের উন্নয়নের প্রধান বাঁধা হিসেবে “দুর্নীতিকে” চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন দুর্নীতির সকল প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করবে দুর্নীতি ও দুর্নীতি বাজরা যে কোন দেশে নগণ ও সমাজের শত্রু। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন- দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তিনি দুঃখ করে বলেন, আমাদের সমাজের অনেক শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিবাজকে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। তাই তিনি লিখেছেন, ‘'’আমি উপলব্ধি করছি যে, সকল পেশাজীবী তথা ডাক্তার, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, আইটি এক্সপার্ট, সৎ-কর্মকর্তা, ব্যাংকের নির্বাহী ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরব ও অহিংস উপায়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখব।’’ তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা-কোন উন্নয়নশীল দেশেই সহজ কাজ নয়। তবে সরকার ও সচেতন জনগণ যদি সংকল্পবদ্ধ হয়-তাহলে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা সম্ভব।
বইয়ের “সমাজ চিন্তার উপাদান” অধ্যায়ে তিনি ‘সামাজিক বৈষম্য’’( যাকে তিনি ক্যান্সার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন), সীমিত নারী স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন। যার ‘সংস্কার করা প্রয়োজন’ বলে তিনি মন্তব্য করেন ।
তিনি মলতা মূলত “বৈষম্যহীন সোনার বাংলার” একনিষ্ঠ সমর্থক, যা তাঁর প্রতিটি লেখাতেই ফুটে উঠেছে। ‘সুষম সমাজ’ বিনির্মাণের জন্য তিনি ২৭ দফা প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। যা ইতিমধ্যে ইতোমধ্যে সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। কেনে মূলত পুঁজিবাদের শোষণ ও সমাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে জীবন মুখি অর্থ ব্যবস্থার কথা বলেছেন। যা সমসাময়িক সময়ে কাউকে বলতে দেখা যায়নি। আমরাও মনে করি, প্রফেসর পারভেজ’র ‘সুষম সমাজ বিনির্মাণ’’ প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার অভাব দূর হবে এবং দেশের বেকারত্ব দূর হয়ে একটা ভারসাম্যময় সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে।
“মসজিদকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা” অধ্যায়ে তিনি নতুন কিছু ভাবনার কথা বলেছেন । কারণ আমাদের সমাজে সচরাচর মসজিদকেন্দ্রিক এমন উন্নয়ন চিত্র দেখা যায় না। মসজিদে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী নামাজ আদায় করা হয়, ধর্মীয় বক্তৃতা হয়। কিন্তু তিনি বলেছেন, মসজিদকে ঘিরে যদি সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা যায়-তাহলে প্গ্রামের প্রান্তিক মানুষের প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। মসজিদকে উপলক্ষ করে- সমবায় পদ্ধতি চাষাবাদ, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি, ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদন ইত্যাদি উৎপাদন করা গেলে মানুষের অভাব থাকবে না।
এই বইয়ের বারোতম অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমলে আমরা ‘বাইশ পরিবারের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ২২ লক্ষ শোষক পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধু এমন বাংলাদেশ চাননি। ৩০ লক্ষ মানুষ এর জন্য প্রাণ দেয়নি। বঙ্গবন্ধু এমন একটি সোনার বাংলাদেশ চেয়েছিলেন- যেখানে ধনী-গরীবের মধ্যে কোন ব্যবধান থাকবেনা, বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু আমাদের অবহেলায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কিন্তু এখন সময় এসেছে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সুষম সমাজ গড়ার আন্দোলন করার। প্রসঙ্গক্রমে প্রফেসর পারভেজ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সুদিনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণেরও পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে- দুর্ভিক্ষ সম্ভাবনা দেখা দেয়, যা প্রতিরোধ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভবই বলা যায়।
প্রফেসর পারভেজ শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা নিয়ে চুপ করে থাকেননি। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নতিতেও অবদান রেখেছেন। তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে বিচরণ করেছেন। সরকারি ব্যাংকের পরিচালক এবং বেসরকারি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি চট্টগ্রামের স্বনামধন্য ইউএসটিসি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথপয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অন্যতম হলো- গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনবিইআর’(ন্যাশনাল ব্যুরো ইন্সটিটিউট অব রিচার্স) প্রতিষ্ঠা করা। যা ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
শুরুর দিকে উল্লেখ করেছিলাম যে, প্রফেসর পারভেজ ধনাঢ্য পরিবারের জন্ম নিয়েও দেশের মাটি ও মানুষের কথা ভেবেছেন। আমরা যদি তাঁর বেড়ে ওঠা ও স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা চিন্তা করি- তাহলে দেখা যাবে আগাগোড়াই তিনি ব্যবসায়ী পিতা ও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা চিকিৎসক মাতার আদরে বড় হয়েছেন এবং জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছেন। ছোটকাল হতেই দেশের সামান্য অনিয়ম, সন্ত্রাস, হানাহানি, খুন, ধর্ষনের সংবাদ তাঁকে বিচলিত করতো। আশৈশব তিনি দেশের সাধারণ দরিদ্র্য মানুষের পাশে থাকার স্বপ্ন দেখতেন, যে স্বপ্ন হতে তিনি এক বিন্দুও সরে আসেন নি। তিনি হয়তো পিতার ব্যবসার হাল ধরতে পারতেন। তাহলে আমরা আজকের সুষম সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রফেসর পারভেজকে পেতাম না। আমরা দেখি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গতানুগতিক জীবন যাপন করেন। তাঁরা শিক্ষা, জ্ঞানার্জন, ডিগ্রী অর্জন এবং সংসার-সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময় ব্যয় করেন। প্রফেসর পারভেজকে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী লক্ষ্য করা যায়। তিনি তাঁর চিকিৎসক সহধর্মিনীর সহায়তায় পরিবারের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেন নি। ‘তাঁর বিত্ত আর সহধর্মিণীর চিত্ত’ মিলে তাঁরা স্বর্গ রচনা করেছেন। তিনি দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এবং দেশের উন্নয়নের জন্য- তাঁর মেধা এবং চিন্তা চেতনাকে নিবেদিত করেছেন। তাঁর পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ ও নিজের অর্জিত সম্পদ- তিনি উঁচু তলার মানুষদের ক্লাবে গিয়ে ধ্বংস করেননি। তিনি তাঁর সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করেছেন। পিছিয়ে পরা মানুষদের সহযোগিতায় সর্বক্ষনিক সাহায্যের হাতকে প্রসারিত করে রেখেছেন। আজকের ‘লোভাতুর’ এই সমাজে তাকে তাই ব্যতিক্রম মনে হয়। উন্নত দেশে পড়াশোনা শেষ করিয়ে যখন তিনি তাঁর ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনেন- তখন অবাক হতে হয়। কারণ এখানে ‘নিরাপত্তা নাই’-এই অজুহাতে আমরা অনেকেই সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে থাকি। আর তিনি দেশকে সেবা দেয়ার জন্য সন্তানকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। এমন মানুষই তো স্যালুট পাওয়ার দাবি করতে পারেন।
প্রফেসর পারভেজ’'র এই বইতে তিনি তাঁর দর্শন সম্পর্কে কয়েকজন লেখকের লেখা স্থান দিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিশিষ্ট কলামিস্ট মুহাম্মদ মুসা খান, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আ ফ ম মোদাচ্ছের আলী, পরিবেশবিদ শাহরুখ নিজাম অন্যতম। তাঁদের লেখায় প্রফেসর পারভেজ’র ভাবনাচিন্তা ও দৃষ্টিভংগির পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ - আজ একজন পরিণত ও পরিপূর্ণ মানুষ। জ্ঞান চর্চা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সুশাসন, পরোপকার
প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর পদচারণা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর এই বই ( এক পলকে একটু দেখা : অধ্যাপক পারভেজ’'র জীবন দর্শন) তরুণ প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা ও দেশের প্রকাশনার ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে- এমন প্রত্যাশা রইল।
লেখক: মুহাম্মদ মুসা খান। প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সমালোচক ও সমাজকর্মী।
ইমেইল : mkhanctgbd@yahoo.com