প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ:
বাজেটে গরীবের প্রাপ্তি কতটুকু? এর উত্তর খুঁজতে যেন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়! তেমন করে দেশের গরিষ্ঠ মানুষ গরীবদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ চোখে পড়ে না। প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়লেও গরীব শ্রেণীর ন্যায্য হিস্যা তাদের না দেওয়ায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধনী-গরীবের ব্যবধান। তাই বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাজেটের টাকা খরচের অংক বাড়লেও কমছে না ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সরকারি খরচ মেটানোর জন্য ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সরকারের উন্নয়নের সুফল সবার ভাগ্য পরিবর্তন করছে কিনা সেটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে এই ব্যবধান বাড়ার কারণ কী?
কারণ খুঁজলে আমরা দেখতে পাবো- বিগত কোন বাজেটেই দারিদ্র শ্রেণীর জন্য তেমন কোন বরাদ্দ নেই। যা আছে তা এত নগণ্য যে তা দরিদ্র শ্রেণীর ভাগ্যে কতটুকু জোটে তা হিসেব করাও দূরহ। অন্ন, বস্তু, দরিস্থান নিয়ে ব্যস্ত থাকে গরীব জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারে বাজেট বা আর্থিক বিবরণীতে কতটুকু বরাদ্দ থাকছে! দেশ উন্নত হচ্ছে, অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে- তাতে গরীবদের কী যায় আসে? তাদের সারাদিনের চিন্তার বিষয় হচ্ছে তিন বেলার ডাল ভাতের জোগাড় করা। কৃষিমজুর, রিকশাওয়ালা, কুলি, দিন-মজুর বা গৃহহীন ভাসমান জনগোষ্ঠী কি কোন বাজেটের হিস্যা পায়! যারা কষ্টের পয়সা দিয়ে চাল-ডাল তেল-নুন কিনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে সমৃদ্ধ করে! ফ্লাইওভার তাদের কী কাজ দেবে! কিম্বা মেট্রোরেলে চড়ার সেই সৌভাগ্য এদের নাই। এরা শুধু চাই তিন বেলা ভাত এবং বউ-বাচ্চা নিয়ে একটুখানি রাতে মাথা গোঁজার জায়গা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান নিয়ে ব্যস্ত থাকে গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারে বাজেট বা আর্থিক বিবরণীতে কতটুকু বরাদ্দ থাকছে? এতে দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কত টাকা ব্যয় হবে, তার কি কোন দিক নির্দেশনা আছে?
প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় বাজেটের আকার অনেক বড় হয়, জনগণের উপর নতুন করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বহু রকমের কর আরোপিত হবে, জনগণের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লাইসেন্স সংসদ থেকে নেওয়া হয় এবং এর সুদও পরিশোধিত হবে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দ্বারাই। এরপর সাধারণ জনগণকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির খতিয়ান শোনানো হয় এবং ১৫/১৬ দিন এ নিয়ে তুমুল বিতর্কের পর অথবা একতরফা আলোচনার মাধ্যমে গরীববান্ধব ও উন্নয়নের বিশাল দলিল আখ্যা দিয়ে তা পাশ হয়ে যাবে। কিন্তু গরীবের নামে যে গরীবকে বঞ্চিত করে যে বাজেটে করা হয় তাতে সবচেয়ে বশি বঞ্চিত হন গরীবরাই। প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়লেও গরীব শ্রেণীর ন্যায্য হিস্যা তাদের না দেওয়ায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধনী-গরীবের ব্যবধান। তাই বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাজেটের টাকা খরচের অংক বাড়লেও কমছে না ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সরকারি খরচ মেটানোর জন্য ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সরকারের উন্নয়নের সুফল সবার ভাগ্য পরিবর্তন করছে কিনা সেটি নিয়ে অনেকেই মনের তোলেন। পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম।
ধনী-দরিদ্রের মধ্যে এই ব্যবধান বাড়ার কারণ কী? বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য নির্ভর করা হয়েছে ব্যাংকিং ঋণ, অব্যাংকিং ঋণ ও বৈদেশিক অনুদানের উপর। অথচ উচিত ছিল খরচের পরিকল্পনাটা এমনভাবে করা যেন ঋণ ও অনুদানের মুখাপেক্ষী না হতে হয়। কিন্তু তা না করে প্রতি বছর ইচ্ছেমতো ঋণ করতে গিয়ে এখন প্রতিটি নাগরিকের ঘাড়ে বিশাল ঋণের বোঝা। আর সে ঋণের সুদ নিজের অজান্তেই আদায় করে যাচ্ছে ধনী-গরীব নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ। বাজেটের বেশিরভাগ খরচ হয় আগের ঋণ পরিশোধ, শ্বেতহস্তির মতো বিশাল সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ, বিলাস দ্রব্য আমদানি, অপচয়, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন প্রকারের সিস্টেম লস, কর-রেয়াতের নামে ধনিক শ্রেণিকে বিশাল ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি কাজে। এসবই হয় ধনিক শ্রেণির স্বার্থে এর বাইরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত থাকায় অর্থনীতিতে লুটপাটের ধারা বহাল থাকে। ফলে ধনী আরো ধনী এবং গরিব আরো গরিব হয়, ধন-বৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্য বৃদ্ধি হয়, সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি ঘটে। বাজেট অর্থের যোগান দেয় দেশের ১৭ কোটি মানুষ। তাই ১৭ কোটি মানুষকে তার হিস্যা বুঝে দেয়া জরুরি। দরিদ্র শ্রেণীর অর্থ দিয়ে ধনীক শ্রেণীর উন্নয়ন শোষণেরই নামান্তর। তথাকথিত এই গণতান্ত্রিক শোষণ বন্ধ করতে সত্যিকারের খাতওয়ারী গরীব বান্ধব নয় গরীবের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
দুর্নীতি ও সুশাসন
এ দুর্নীতি যেনো ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় পড়ে ২৮কোটি টাকা, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১০কোটি টাকা আর চীনে ১৩কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশের তিনটি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় ধরা হচ্ছে কিলোমিটার প্রতি ৫৯কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক চারলেন নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫কোটি টাকা। (সূত্রঃ বণিক বার্তা, অক্টোবর ৬, ২০১৫) ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ভারতে প্রতি কিলোমিটার ৪৮ থেকে ৮৮কোটি টাকা, চীন এবং মালয়শিয়ায় ৮০ থেকে ৯০কোটি টাকা, বাংলাদেশ এ ১৫০ থেকে ১৮০ কোটি টাকা। (সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, মে ৩১, ২০১৬) চীন অথবা ভারতে প্রতি কিলোমিটার রেল পথ নির্মাণের ১২কোটি টাকা, উন্নতদেশগুলোতে সর্বোচ্চ ৩০কোটি টাকা, আর বাংলাদেশে দোহাজারী-ঘুনধুম ১৩৯কোটি টাকা, ঢাকা- যশোর ২০৩কোটি টাকা, আর ঢাকা-পয়রা বন্দর ২৫০কোটি টাকা। (সূত্রঃ কালের কন্ঠ, জানুয়ারি ১৪, ২০১৭) দুর্নীতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র হচ্ছে জ্বালানি। ২০০৯ সালে সরকার জনগণকে জানায় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুব স্বল্প মেয়াদি হবে; তীর ঘাটতি টাকা টিয়ে উঠে সাথে সাথে কয়লা বা গ্যাস ভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়ে ওগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু পরে কয়েক দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২০ সাল পর্যন্ত। এ কারণে ২০১১সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পিডিবিকে লোকসান দিতে হয়েছে ৬০হাজার কোটি টাকা, আর লাভবান হয়েছে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতিরা। এর জন্য করা হয়েছে ইনডেমোনিটি।
সবাই বালিশ নিয়ে ব্যস্ত, অথচ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত দুর্নীতি সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। এই কেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের মূলধন ব্যয় হবে ৫০লাখ ডলার। অথচ সম্প্রতি স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী ভারতে একইদেশ রাশিয়ার নির্মিত কুদান কুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে প্রতি মেগাওয়াটে ৩০লাখ ডলার। (প্রথম আলো, ০৮, ০১, ২০১৮)। অর্থাৎ ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আমরা ভারতের তুলনায় বেশি ব্যয় করছি ৪০,৮০০কোটি টাকা। করের টাকায় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী পুষলেও সরকারি কাজ করাতে গিয়ে নাগরিকদের ঘুষ দিতে হয় প্রতি বছর প্রায় ১১হাজার কোটি টাকা (টিআইবির খানা জরিপ)। এসব লুট-ঘুষের টাকায় ধনীর সংখ্যা বাড়তেই থাকে, আর কমে আপামর জনসাধারণের আর্থিক সক্ষমতা। ওদিকে এইদেশে সুশাসনেরও তীব্র ঘাটতি আছে। তার কারণে এইদেশে প্রতি বছর দেখা যায় উন্নয়ন বাজেটের একটি অংশই বাস্তবায়িত হয়নি। এটাও আমাদের দেশের বাজেট বরাদ্দের সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছতে দেয় না। দূর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ বন্ধ কা না গেলে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সুদুড় পরাহত হবে। যা সিরিয়াজলি চিন্তা করা প্রয়োজন। একটি স্বচ্ছ, কার্যকরী, দক্ষ, দায়বদ্ধ, অংশগ্রহণ মূলক, দায়িত্ববোধ সম্পন্ন, আইন অনুসরণকারী, সংবেদনশীল, ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসন গঠন করার মাধ্যমে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে বাজেট কখনোই জনগণের প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনবে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিকস রিসার্চ (এনবিইআর)।