সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

‘গিগ অর্থনীতি’ বনাম তরুণদের বিসিএস মুখিতা

শনিবার, মে ১৮, ২০২৪
‘গিগ অর্থনীতি’ বনাম তরুণদের বিসিএস মুখিতা

আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা:

বাংলাদেশে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে কিংবা চাকরি প্রত্যাশীদের মাঝে বিসিএসের জনপ্রিয়তা নতুন কিছু নয়। ক্ষমতা, সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা, সেই সাথে আসা সুযোগ-সুবিধার লোভে হোক কিংবা বিসিএস ক্যাডারদের প্রতি ‘অস্বাভাবিক’ সামাজিক সম্মানের কারণে হোক, অথবা চাকরির বাজার হিসেবে দেশের বেসরকারি খাতের অনিশ্চিত ও অনুন্নত অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকার কারণে হোক, অনেকটা স্নাতক সম্পন্নের পূর্বেই শুরু হয় তরুণদের বিসিএস গাইড গলাধঃকরণ। 

চাকরি পরীক্ষার সুস্থ পদ্ধতি হিসেবে বিসিএসের বর্তমান ধরন কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। তবে বিসিএসের জনপ্রিয়তা না কমলেও বাড়ছে তরুণদের মাঝে আউটসোর্সিং ভিত্তিক কাজের ঝোঁক। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে তরুণদের মাঝে এ ধরনের নতুন আগ্রহ দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং অনলাইনভিত্তিক কর্মক্ষেত্র বিশ্বজুড়েই হয়ে উঠছে কাজের জগতের  বড় এক  ভরকেন্দ্র। যাকে এখন বলা হচ্ছে ‘গিগ অর্থনীতি’। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে প্রসারিত বেশ প্রসারিত হয়ে গেছে ‘গিগ’ জগত এবং  বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাও যুক্ত হচ্ছে  তাতে বিপুল হারে।

‘গিগে’র জগত কর্মীদের পছন্দের সুযোগ থাকছে
‘গিগ ইকোনমি’র সাথে বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রান্তিক মানুষ পরিচিত না হলেও, দেশের বড় একটি অংশ বিশেষ করে শহুরে বা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতসমাজের বেশিরভাগই এ অর্থনীতির ভোক্তাসমাজ। পাঠাও, উবার, ফুডপান্ডা, দারাজ, রকমারি ইত্যাদি এ গিগ ইকোনমিরই অংশ। 

গিগ ইকোনমি মূলত অনলাইনভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা, যেখানে কর্মসংস্থান সাময়িক ও শর্তসাপেক্ষ। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্পমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে তাদের ইচ্ছামতো কর্মীদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজে নিয়োগ দেয় এবং কাজের মানের উপর পারিশ্রমিক প্রদান করে। তবে গিগ ইকোনমির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, কর্মীরা তাদের কাজের ধরন, পারিশ্রমিক, কাজের সময়কাল ও সময়সীমা এবং কাজের কর্মপরিবেশ ইত্যাদি পছন্দমত দরদাম এবং নির্ধারণ করতে পারে। 

করোনা মহামারীকালীন সময়ে সারা বিশ্বে বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দি ছিল, ফলে ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মী চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। তবে করোনার আগেও বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানের প্রায় ৩৪ শতাংশ ছিল গিগ অর্থনীতির দখলে। করোনা তাকে নতুন গতি দিয়েছে কেবল।

বাংলাদেশের তরুণদের মাঝেও এখন গিগ অর্থনীতির জনপ্রিয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০২১ সালের অযাচাইযোগ্য এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট ২৭ শতাংশ জনবল গিগ অর্থনীতির সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত এখন। এক্ষেত্রে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের (বিসিজি) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ফ্রিল্যান্সারদের ১৫ শতাংশই বাংলাদেশের। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন এখন।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, প্রথমত, ঢাকা কিংবা যেকোনো শহুরে পরিবেশে বিশ্বববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রায় সামর্থ্যের চেয়ে ব্যয় বেশি। সেক্ষেত্রে চাকরি প্রস্তুতির ইচ্ছা সত্ত্বেও বেশিরভাগ তরুণ খরচ সামাল দিতে যুক্ত হয়ে পড়েন ‘প্রাইভেট পড়ানো’ কিংবা নানা খন্ডকালীন কাজে। দ্বিতীয়ত, জনবলের তুলনায় চাকরির স্বল্পতার কারণে আজকাল যোগ্যতা প্রমাণের জন্য সার্টিফিকেট কিংবা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া কোথাও খুব একটা নিয়োগ দেয়া হয় না। সেক্ষেত্রে, তরুণদের জন্য অনলাইনভিত্তিক নানা কাজ করে পোর্টফলিও ভারি করাই হল বিকল্পহীন বাজি।

বিসিএস যেখানে নিশ্চিত করছে স্থায়ী কর্মপরিবেশ ও সুযোগ সুবিধা, গিগ অর্থনীতি সেখানে তরুণদের দিয়েছে সময় ও পরিবহন খরচ বাঁচিয়ে বাসায় বসেই কাজ করার সুযোগ। পাশাপাশি কারোর অধীনস্থ না থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বাধীনতা। এটা প্রায় সকলেই এখন জানেন যে, গিগ অর্থনীতি যেহেতু ইন্টারনেটভিত্তিক, তাই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসে যেকোনো দেশের প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা যায়, এমনকি সুযোগ থাকে ব্যবসা সম্প্রসারণেরও। প্রশিক্ষণ বাবদ স্বল্প বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত সামান্য খরচপাতির পরই কর্মীরা তাদের পছন্দমত নানা দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করতে পারছেন এখন। 

বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের সামনে সরকারি চাকরির যে ‘মর্যাদা’, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে ঠিক অনুরূপ গিগ অর্থনীতির কদর। সেখানে পারিশ্রমিকের পরিমাণ কর্মীদের কাছে ন্যায্য হিসাবে বিবেচিত হওয়ার প্রতিযোগিতাও আছে। আছে বাছাইয়ের সুযোগও। প্রয়োজন মোতাবেক দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ থাকলেই তরুণেরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা রাখে এই পরিসরে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে সেদিকে আরও প্রসারিত হবে কি না—নাকি বিসিএসের মরীচিকায় আটকে থাকবে? বাস্তব  বার্তা  অবশ্য ইতিবাচক।

বাংলাদেশে এখনকার অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইনভিত্তিক মার্কেটপ্লেস হলো ফাইবার। ইসরায়েলী প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে এটি এতটাই জনপ্রিয় যে বেশিরভাগই অন্যান্য মার্কেটপ্লেস যেমন- ফ্রিল্যান্সিং, আপওয়ার্ক, পিপল পার আওয়ার ইত্যাদি সম্পর্কে জানেই না। ফাইবারের মাধ্যমে ঘরে বসেই তরুণেরা গ্রাফিক্স ডিজাইন, গান কম্পোজ, লেখালেখি, অনুবাদ, অ্যানিমেশন ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার সুযোগ পায়, পাশাপাশি পোর্টফলিওতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নানা অভিজ্ঞতাও লাভ করে।

তরুণরা কোনদিকে যাবে?
পুঁজিবাদী অর্থনীতির ডিজিটাল বিন্যাস এই গিগ অর্থনীতি। গিগ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অসুবিধা, তরুণদের ঘরকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। আরেকটা সমস্যা এখানকার কর্মীর শ্রম আইনের সুরক্ষা নেই। আমাদের শ্রম আইন  এতটা আপডেইট হয়নি আজও। তবে অল্প পরিশ্রমে, বাসায় বসে অনায়াসে পারিশ্রমিক অর্জন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য একটি সুবিধা। আবার এতে করে তরুণদের যোগাযোগ ক্ষমতা কিবোর্ডে টাইপিং পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। দীর্ঘকাল এই ধরনের  কাজে থাকলে অনলাইনের বাইরের দুনিয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া কারো কারো জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। অথচ  মূল ‘সমাজ’ তো সেখানেই।

আবার ‘গিগ অর্থনীতি’ মূলত উচ্চশিক্ষিত মজুরদের কর্মক্ষেত্র। পারিবারিক আর্থিক সামর্থ্য, যথাযথ দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ এবং নিজের পরিবেশ আধুনিক প্রযুক্তি অনুকূল হলেই কেবল এ অর্থনীতিতে অবদান রাখা সহজ। কিন্তু বাংলাদেশে চাকরি প্রত্যাশীদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত কিংবা আরথিকভাবে সচ্ছল নয় এমন পরিবার থেকে আসছে। নিজের ও পরিবারের জন্য একটি স্থায়ী ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এরকম তরুণদের হাতে সময় বেশি থাকে না। ফলে অনেক সময়ই তারা অনিশ্চিত কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হতে কম আগ্রহী হয়। তাদের দরকার স্থায়ী ও টেকসই কিছু! কিন্তু ‘টেকসই’ কর্মজগতের পরিসর এখানে ছোটই এখনও। ফলে যাবতীয় সীমাবদ্ধতা নিয়েই গিগ অল্পবয়সীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। 

কিন্তু জনপ্রিয়তায় বিসিএসকে হারাতে পারেনি গিগ।  গ্রাজুয়েট তরুণদের মাঝে তার আকর্ষণ এখনো যথেষ্ট প্রবল। তাই এখনো দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় সকালে লাইব্রেরির সামনে বিসিএস প্রত্যাশী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের লম্বা লাইনের ছবি প্রাধান্য পায় এবং তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক ওঠে। অথচ বিতর্কটা হওয়া দরকার টেকসই চাকুরি জগত কেন বাড়ছে না দেশে—সে বিষয়ে।

‘সমস্যা’টা কি কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের?
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, গিগ অর্থনীতি যেভাবে সারা বিশ্বে প্রসার লাভ করছে তাতে করে বাংলাদেশেও এর আওতা বাড়বে। পুঁজিতন্ত্র এভাবেই নিজেকে বদলে নিবে। বাংলাদেশেও সরকার চাইলে এ খাতকে আরও উন্নত ও টেকসই চেহারা নিতে পারে। ইন্টারনেট সুবিধা আরও সস্তা ও দ্রুতগতির করে এবং শ্রম আইনকে সংস্কার করে সরকার এই খাতের উন্নয়ন ঘটাতে পারে চাইলে। তাতে দেশ লাভবান হবে। 

চাকরির বাজারের সংকটকালে যতক্ষণ না কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুমুখী করা হবে ততক্ষন পর্যন্ত বিসিএস এবং অন্যান্য ধরনের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার অমানবিক ও প্রায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদেরও তখন গবেষণা ও স্বাভাবিক পাঠের কাজ বাদ দিয়ে গাইড পড়ার  জন্য  সকাল-সকাল লাইব্রেরির দিকে  ছুটতে হবে। সমস্যাটা কিন্তু কেবল তাদের নয়, পুরো রাষ্ট্রের। ফলে ঐ তরুণদের ‘ট্রল’ করে এর কোন  সমাধান পাবো  না আমরা। ‘গিগে’র জগতেও  কিছু  সমাধান খুঁজতে পারি আমরা।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল