প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ:
আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য আট লাখ কোটি টাকার বাজেট দিচ্ছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এবার সংকোচনমূলক বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়।
আরেকটা বাজেটের সামনে বাংলাদেশ। বাজেট উপস্থাপনের আগে দেশে চলে নানা আলোচনা, প্রশ্ন। দেশের বাজেট নিয়ে তার ’গরীব বান্ধব বাজেট’ বইতে কিছু প্রশ্ন করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিকস রিসার্চ (এনবিইআর) চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ। আজকের আলোচনায় রয়েছে তার প্রথম পর্ব ‘জিডিপির হিসাব কতটা নির্ভরযোগ্য’
প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ তার বইয়ে লিখেছেন, মালয়েশিয়ার প্রধান মন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'আমাদের বুঝতে হবে যে উন্নত জাতি হয়ে ওঠা কখনোই সম্ভব হবে না, যদি আমরা কেবল সুউচ্চ দালানই দেখাতে থাকি, বিপরীতে আমাদের নদী গুলো দূষিত হয়ে যায়, আমাদের বনভূমির জায়গা মরুর আকার ধারণ করে এবং যে বাতাসে আমরা শ্বাস নিই, তা মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে।' মাহাথিরের এই বক্তৃতা পড়ে ৪০ বছর আগের আরেকটি বক্তৃতার কথা মনে পড়ে গেল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির আইনবিদ ও রাজনীতিক ভাই রবার্ট কেনেডি ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে এক দীর্ঘ বক্তৃতায় বলে ছিলেন, 'আমরা যখন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির গণনা করি, তখন বায়ুদূষণ, সিগারেটের বিজ্ঞাপন, মহাসড়কে হতাহতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা সবই এর অন্তর্ভুক্ত করে নিই। এমন কি আমাদের দরজার বিশেষ তালা গুলো যারা ভাঙে, তাদের রাখার জেলখানার পরিমাণ ও জিডিপি গোনায় ধরা হয়।
আবার রেডউড যে ভাবে ধ্বংস করা হয় এবং আমাদের প্রাকৃতিক আশ্চর্যগুলো যেমন বিশৃঙ্খল ভাবে ভেঙে পড়ে, তাও জিডিপি গণনার মধ্যে ধরা হয়। বোমায় ব্যবহৃত পেট্রল, পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র এবং দাঙ্গা রুখতে পুলিশের সাঁজোয়া যান, তাও জিডিপি গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য, স্কুলের শিক্ষার মান কিংবা খেলার আনন্দকে গোনায় ধরে না। আবার জিডিপি আমাদের কবিতার সৌন্দর্য কিংবা বিয়ে ব্যবস্থার শক্তির দিক, বুদ্ধিদীপ্ত গণবিতর্ক কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মনিষ্ঠাকে ও গোনায় ধরতে জানে না। এমনকি আমাদের বৃদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, সাহস, প্রজ্ঞা, শিখতে পারার ক্ষমতা, আমাদের আবেগ, আমাদের দেশভক্তি কোনো কিছুকেই গোনায় ধরে না এই জিডিপি। আসলে জিডিপি সবকিছুই মাপে, কেবল যা যা আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে, সে সব ছাড়া।' ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত একটি দেশের উন্নতির পরিমাপক হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বেশ জনপ্রিয় ছিল। ঠিক সেই দশকেই ববি কেনেডির এই বক্তৃতা যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
তবে অর্থনীতিবিদেরা জিডিপি থেকে সরে এসে ছিলেন সত্তরের দশকে এসে। কারণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা বা মোহ দেশের মধ্যে আয় বৈষম্য বাড়ায়। এ কারণেই এত বছর পরেও জিডিপি আলোচনায় ববি কেনেডির এই বক্তৃতার কথা অনেকেই স্মরণ করেন। তবে জিডিপি মানেই উন্নতি এই ধারণা থেকে সবাই যে বেরিয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। জিডিপি নিয়ে বিতর্ক শেষ হয় নি। তবে বাংলাদেশে এনিয়ে আলোচনা অবশ্যই অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন। কেননা, বাংলাদেশ যেমন সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পাঁচটি দেশের একটি, তেমনি সর্বোচ্চ আয় বৈষম্যের দেশগুলোরও একটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সবাই যখন প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা ধরনের বুদ্ধি ভিত্তিক আলোচনা করছে, তখন আমরা কথা বলছি প্রবৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে, পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে।
প্রবৃদ্ধি নিয়ে এক ধরনের মোহ আছে আমাদের। কেউ কেউ বলেন, 'হাতির ঝিলে গেলে মনে হয়, প্যারিস শহরের কোনো অংশে এসেছি। আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস মনে হয়। কুড়িল ফ্লাইওভার দেখলে মনে হয় এটি কোনো সিনেমার দৃশ্য।' এক মন্ত্রী বললেন, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবদান হবে কানাডার সমান। আমরা এ ধরনের কথাবার্তা সামনে হয়তো আর ও শুনব। এ অবস্থায় জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি থেকে আমরা কী পাচ্ছি, এই আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। দৃশ্যমান প্রভাব না থাকলে জিডিপির প্রকৃত অর্জন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। দেশের গবেষণা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের জিডিপির মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। যেমন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সমালোচনামূলক আলোচনা সভায়- জিডিপি প্রবৃদ্ধির মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
বিআইডিএস বলেছে, দুইভাবে প্রবৃদ্ধির মান বুঝতে পারা যায়। এর একটি আয়বৈষম্য, যা বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যটি কর্মসংস্থান, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তেমন বাড়েনি বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। অনেকের মতো বিআইডিএসও এটাকে বলেছে, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। সরকার রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়কে প্রবৃদ্ধির বড় উৎস হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু বিআইডিএস বলছে, গত কয়েক বছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় দুটোরই গড় প্রবৃদ্ধি কমেছে। একই ধরনের বিশ্লেষণ করেছে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্পখাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও বেসরকারি বিনিয়োগের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পেছনের সারির একটি দেশ। অথচ ক্রমবর্ধমান মূলধন উৎপাদন অনুপাত (ইন ক্রিমেন্টাল ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও) কমছে বলে সরকার বলছে। এনিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, গত পাঁচ বছরে গড়ে ৭শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমে গেছে। যেমন, ২০০৫-১০ সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনের হার ছিল ১দশমিক ৭শতাংশ আর ২০১০-১৬ সময়ে তা কমে হয়েছে ১দশমিক ২শতাংশ। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির লাভ কার পকেটে গেল? নাকি হিসাবে গন্ডগোল আছে?
একই ধরনের সমালোচনা করেছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির ভাষ্য হচ্ছে, বিভিন্ন খাতের যে অবদান থাকার কথা, সেটা অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে না, অথচ উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে। আবার এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে যেহেতু বিনিয়োগ বেশি হয়নি, সেহেতু শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি হতে হবে।
কিন্তু গত কয়েকবছরে বাংলাদেশে এমন কোনো প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন যুক্ত হয়নি বা রূপান্তর ঘটেনি যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেছে। আর শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়লে শ্রমিকের আয় বাড়ার কথা। কিন্তু সরকারের তথ্য-উপাত্তই বলছে, বৈষম্য বাড়ছে। সুতরাং যেধরনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তাতে আয় ও কর্মসংস্থানের যে চিত্রটি আসে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তা বাস্তব সম্মত নয়। সিপিডি একধাপ এগিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব কীভাবে নিরূপণ হলো, তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত জিডিপি বিতর্ক নিয়ে মুখ খুলতে হয়েছে সরকারের। যেমন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জিডিপির সমালোচকদের নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'আমি ব্যাখ্যা দিতে চাই। কোথাও গোলটেবিল আয়োজন করুক, আমি সব প্রশ্নের জবাব দেব।'
প্রবৃদ্ধির অর্জন নিয়ে বিতর্ক অবশ্য এবারই প্রথম নয়। যেমন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, অথচ কৃষি খাতে ছিল ঋণাত্মক, প্রবাসী আয়ও কমে গিয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরেও ৭দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। অথচ ওই অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল প্রায় সাড়ে ১৪শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল খুবই সামান্য, ১শতাংশের কিছু বেশি। প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় পরের অর্থ বছরেও। সরকারের প্রাথমিক প্রাক্কলন ছিল, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কিন্তু হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬শতাংশ। এই হার নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য ছিল, উৎপাদন সক্ষমতা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান খুব বেশি না বাড়লেও কেবল ভোগ ব্যয়ের ওপর ভর করে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাব বিশ্বাসযোগ্য হবে না। জিডিপি নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য তার সংকট এবারও দেখা দিল। এই সংকট নিরসন করা জরুরি। কেননা, স্বাধীনতার ৪৮বছর পরেও আমরা একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। দুঃখজনক হচ্ছে, সারাবিশ্ব যখন প্রবৃদ্ধির বাইরে গিয়ে সুখ বা ভালো থাকার উপায় নিয়ে কথা বলছে, আমরা তখন আলোচনা করছি জিডিপির পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। পরিসংখ্যান সঠিক না হলে দেশের প্রকৃত চিত্র জানা যাবে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিকস রিসার্চ (এনবিইআর)।