নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ যোগদান করেই পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে বিধিবহির্ভূতভাবে জৈষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করে নিয়োগ পাওয়া ডিন ও বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অফিসে এই সভা ডেকেছেন। এই ডিন ও বিভাগীয় প্রধানদের দায়িত্বে থাকা পরিচালকরাই গত ৪ আগস্ট হাসিনা সরকারের নির্দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ ও শান্তি সমাবেশের আয়োজন করেছে। তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমানোর জন্য হামলার নির্দেশ দিয়েছে, চক্রান্ত করেছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সিনিয়র শিক্ষক, কর্মকর্তারা গত ১৭ বছর নির্যাতিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত হয়ে ছিলেন, তাদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই এই বৈঠক ডেকেছেন উপাচার্য। এনিয়ে ক্যাম্পাসে বৈষম্যের স্বীকার শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তারা বলছেন, নতুন উপাচার্য যোগদান করেছেন, ক্যাম্পাসে এসেছেন। তিনি ছাত্রজনতার রক্তের ঋণের উপর দাঁড়িয়ে উপাচার্য হয়েছেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত- তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে খুনি হাসিনার সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠক ডেকেছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত প্রশাসন কোনো ধরনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে সিনিয়রদের পাশ কাটিয়ে জুনিয়ারদের পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেন। এর মধ্যে রয়েছেন আঞ্চলিক কেন্দ্র সমন্বয় দপ্তরের পরিচালক হোসনেয়ারা বেগম। তাকে অন্তত শতাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে পরিচালক বানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে তার যে পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছে তিনি ছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের স্ত্রী। যিনি ছাত্র-জনতা খুনের আসামী এবং বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মেজবাহ উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। তাকে বানানো হয়েছিল পরিবহন দপ্তরের পরিচালক। খুনি হাসিনার দোসর হিসেবে তিনি পরিবহন দপ্তরকে দুর্নীতির আঁকড়ায় পরিণত করেছিলেন। ভুয়া বিল, দপ্তরের বিভিন্ন জনের নামে অগ্রিম উত্তোলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করতেন মেজবাহ উদ্দিন। অ্যাপ্যায়নের নামে ভুয়া ভাউচার বানিয়ে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে নারী কেলেঙ্কারীর অভিযোগ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী কর্মকর্তাদের তার দপ্তরে পদায়ন করে নিতেন। এসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মশিউর রহমান প্রশাসন তাকে প্রাইজ পোস্টিং হিসেবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বানিয়েছেন। কলেজ মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশন দপ্তরের পরিচালক এ এস এম রফিকুল আকবারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের কোনো শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদের আমলে বদলি ও পদোন্নতিতে তার একাচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। তিনি এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তৎকালিন সময়ের প্রক্টর বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা দপ্তরের পরিচালক এএইচএম তায়েহীদ জামালের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তিনি ফ্যাসিবাদী ও খুনি হাসিনার রাজনৈতিক আদর্শের সৈনিক। প্রক্টর থাকাকালীন প্রভাব বিস্তার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক মো. সাজেদুল হকও এই সিন্ডিকেটের সদস্য। তিনি অনেক সিনিয়রকে ফেলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ দপ্তরটি বাগিয়ে নিয়েছেন। তার পুরো পরিবার খুনি হাসিনার রাজনীতির ধারণ করে। তথ্য ও সেবা দপ্তরের পরিচালক ইমান উদ্দিন সরকার ও শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা দপ্তরের পরিচালক মু. আখতারুজ্জামানের শিক্ষাগত যোগত্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নমান সহকারী হিসেবে যোগদান করেছে। এই পদে থেকে পরিচালক হওয়ার ইতিহাস বাংলাদেশে বিরল। শুধু ফ্যাসিবাদের সমর্থক হওয়ায় অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে তাদের পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করা হয়েছে। ইমান উদ্দিন সরকারের আপন ছোট ভাই আমিন উদ্দিন সরকার যুবলীগের নেতা। গাজীপুরে বোর্ডবাজারে এই আমিন উদ্দিনের নির্দেশে ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালানো হয়েছে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ দপ্তরের পরিচালক মো. হাছানুর রহমান, প্রকিউরমেন্ট এন্ড স্টোর দপ্তরের পরিচালক মো. আবু হানিফ, আইন দপ্তরের পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শুদ্ধাচার দপ্তরের পরিচালক জয়ন্ত ভট্টাচার্য্য, রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেন, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা দপ্তরের পরিচালক মো. শফিক উল্লাহ, জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক মো. আতাউর রহমান, প্রকাশনা ও বিপণন দপ্তরের পরিচালক আ. মালেক সরকার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক সুমন চক্রবর্তী, কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানাসহ সকল পর্যায়ের পরিচালকরা ছিলেন খুনি হাসিনা সরকারের সমার্থক ও দোসর। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে ভুয়া বিল বানিয়ে বিভাগীয় কনটিনজেন্সীর অর্থ আত্মসাতসহ নানা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকপূর্ণ শিক্ষা বিষয়ক স্কুলের ডিন অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। নারী কেলেঙ্কারী, বিভাগীয় কনটিনজেন্সীর অর্থ আত্মসাৎ, লাইব্রেরি সায়েন্স ও বিভিন্ন বিভাগের ভর্তি পরীক্ষার অর্থ আত্মসাৎ, রেজিস্ট্রেশন, কলেজ ট্রান্সফার (টিসি)সহ নানা বিষয়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন গুরুতর নানা অভিযোগে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে চাকরিচ্যুত হন। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগদান করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে তিনি ব্যাপক বিরোধী ছিলেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। তার স্ত্রী প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। বিগত স্বৈরশাসকের আনুকূল্যে তাকে প্রাইজ পোস্টিং হিসেবে সিঙ্গাপুরে পদায়ন করা হয়। কারিকুলাম উন্নয়ন ও মূল্যায়ন কেন্দ্রের ডিন প্রফেসর মনিরুজ্জামান শাহীনের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। তিনি সাবেক ভিসি হারুন-অর-রশিদের আমলে কলেজ পরিদর্শক ছিলেন। ওই সময়ে বিভিন্ন কলেজের জিবি গঠন, অধিভুক্তি ও নবায়নের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দপ্তরের বিভাগীয় কনটিনজেন্সির টাকা নামে-বেনামে বিল-ভাউচার করে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যে টাকায় দপ্তরের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আপ্যায়ন ও দাপ্তরিক ব্যয় নির্বাহ করার কথা সেই টাকা তিনি ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাৎ করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ৩৫ লক্ষ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু ও সুচারূরুপে পরিচালনা করতে হলে ফ্যাসিবাদের দোসর ও পলাতক খুনি হাসিনার সময়ে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া পরিচালকদের অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ নানা কার্যক্রমে সাবোটাজ করে উচ্চশিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্রকারীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সময়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তারা অত্যন্ত দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদেরকে যদি এসব দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
এমআই