রাইসা মেহজাবীন:
মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের কথা আমরা প্রায়ই শুনি, যা আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক জীবন, সামাজিক পরিস্থিতি এমনকি প্রযুক্তির ক্রমাগত ব্যবহারের কারণে আমরা স্ট্রেসের শিকার হচ্ছি। তবে, স্ট্রেসের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাই—মানসিক চাপের প্রতি আসক্তি। অনেকেই জানেন না যে, স্ট্রেস শুধু আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, এটি আমাদের জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে যেতে পারে যে আমরা একসময় এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি।
স্ট্রেসের প্রতি আসক্তি: কী এবং কেন?
আসক্তির ধারণাটি সাধারণত মাদক, এলকোহল বা জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। কিন্তু স্ট্রেসের ক্ষেত্রে এটি কীভাবে প্রযোজ্য হতে পারে? আসলে, আমাদের শরীর যখন স্ট্রেসের মধ্যে থাকে, তখন এটি কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিনের মতো হরমোন নিঃসরণ করে, যা আমাদের শরীরকে "লড়াই বা পালানোর" অবস্থায় নিয়ে যায়। এই হরমোনগুলো শরীরকে সতর্ক এবং উদ্দীপ্ত রাখে। ক্রমাগত চাপের মধ্যে থাকলে শরীর এই অবস্থার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তা ছাড়া থাকতে পারি না।
কর্মক্ষেত্রে প্রায়শই আমরা এই অভ্যাসটি দেখি, যেখানে কাজের চাপ এক ধরণের শক্তি বা উদ্দীপনা দেয়। কিছু মানুষ এমনভাবে এনার্জি পান যে তারা চাপ না থাকলে কাজের মধ্যে তেমন মনোযোগ বা উদ্যম খুঁজে পায় না। এর ফলস্বরূপ, তারা স্ট্রেসমুক্ত পরিবেশকে অস্বস্তিকর এবং একঘেয়ে মনে করতে শুরু করে এবং নিজেদেরকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাখার চেষ্টা করে।
স্ট্রেসের প্রতি আসক্তির লক্ষণ
স্ট্রেসের প্রতি আসক্তির অনেক লক্ষণ আছে। আপনি যদি নিজেকে নিম্নলিখিত অবস্থায় খুঁজে পান, তাহলে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে-
অবিরাম কাজ: আপনি কাজ শেষ করার পরেও কাজ খুঁজে বের করেন এবং কাজের মধ্যে ডুবে থাকার চেষ্টা করেন।
শারীরিক উপসর্গ:ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা ইত্যাদি সাধারণ স্ট্রেসের লক্ষণগুলোও হতে পারে আসক্তির প্রভাব।
মানসিক অস্থিরতা: আপনি যদি শান্ত বা শিথিল থাকার সময় অস্বস্তি অনুভব করেন এবং কোনো না কোনোভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চান, তাহলে সেটিও একটি সতর্কবার্তা।
অতিরিক্ত কফি বা এনার্জি ড্রিংকস: আপনি যদি দিনের অধিকাংশ সময় এনার্জি ধরে রাখতে এই ধরনের পানীয়ের উপর নির্ভর করেন, তবে সেটিও একটি বিপদের ইঙ্গিত।
আসক্তির প্রভাব এবং প্রতিকার
স্ট্রেসের প্রতি আসক্তির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। এটি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক বিষণ্নতা এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। এক পর্যায়ে, এই অবস্থা আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পেশাগত দক্ষতা এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এটি মোকাবেলা করার জন্য, প্রথমেই প্রয়োজন সচেতনতা। আপনাকে নিজেকে জানতে হবে এবং বুঝতে হবে কিভাবে স্ট্রেস আপনাকে প্রভাবিত করছে। রুটিনে পরিবর্তন আনা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, মেডিটেশন বা যোগব্যায়ামের মতো চাপ কমানোর উপায়গুলো অনুশীলন করা জরুরি। সামাজিক সংযোগ রক্ষা করা এবং মাঝে মাঝে নিজেকে কিছুটা বিরতি দেওয়া স্ট্রেসের আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক হতে পারে।
স্ট্রেস জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তবে এর প্রতি আসক্তি হয়ে উঠলে সেটি আরও গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে। আমাদের সময়ে সময়ে একটু থেমে নিজেদের মূল্যায়ন করা এবং স্ট্রেসের আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থায়ী সুখ এবং মানসিক শান্তি অর্জনের জন্য, স্ট্রেসের সঙ্গে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য। সচেতন থাকুন, জীবনকে উপভোগ করুন এবং স্ট্রেসকে এমনভাবে মোকাবিলা করুন যেন এটি আপনার জীবন নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে।
লেখক: রাইসা মেহজাবীন
শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ অফ অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স।