রাইসা মেহজাবীন:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে জীবনযাত্রাজনিত রোগ, বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এসব রোগ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে দ্রুত নগরায়ন, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বাড়তি গ্রহণ এবং শহুরে মানুষের স্থবির জীবনযাপন। একটি খাদ্যসংস্কৃতি এবং কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে, বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমন এক খাদ্যাভ্যাস, যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, এবং যা রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, সেটি হলো ড্যাশ ডায়েট (DASH Diet)—ডায়েটারি অ্যাপ্রোচেস টু স্টপ হাইপারটেনশন।
এই সম্পাদকীয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ড্যাশ ডায়েট কীভাবে গ্রহণ করা যায় তা ব্যাখ্যা করবে, যেখানে উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগ জনস্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
ড্যাশ ডায়েটের গুরুত্ব
ড্যাশ ডায়েট ১৯৯০-এর দশকে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH)-এর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়। এর প্রধান লক্ষ্য হল সোডিয়াম গ্রহণ কমানো এবং ফলমূল, সবজি এবং সম্পূর্ণ শস্যের পরিমাণ বাড়ানো। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ড্যাশ ডায়েট অনুসরণ করেন তাদের রক্তচাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, এমনকি ক্যালরি কমানো বা ওজন হ্রাস ছাড়াই। ড্যাশ ডায়েট কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে—যা বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ড্যাশ ডায়েটকে বাংলাদেশী সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো
ড্যাশ ডায়েটের মূলনীতি—কম সোডিয়াম, বেশি পটাশিয়াম, এবং ফল ও শাকসবজির ওপর জোর—এগুলো সর্বজনীন হলেও, সেগুলোকে স্থানীয় খাদ্যাভ্যাস ও সরবরাহের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশে ধান, ডাল, মাছ এবং শাকসবজি প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব ঐতিহ্যবাহী খাদ্য সামান্য পরিবর্তন করে, ড্যাশ ডায়েটের মূলনীতি অনুসরণ করা সম্ভব, যা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সহজ।
চাল
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য হল সাদা চাল, যা পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেটের একটি বড় উৎস এবং এতে ফাইবার ও পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। যদিও চাল সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া কঠিন, তবে বাদামী চাল বা সাদা চালে কুইনোয়া বা বাকউইটের মতো শস্য মিশিয়ে খাওয়া একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হতে পারে। বাদামী চাল ফাইবার, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামে সমৃদ্ধ, যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
ডাল
বাংলাদেশে ডাল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন উৎস, যা প্রাকৃতিকভাবে চর্বি ও সোডিয়ামে কম। অতিরিক্ত লবণ ও তেল কমিয়ে ডালকে স্বাস্থ্যকরভাবে গ্রহণ করা যায়। ডায়েটে লাল মসুর, মুগ ডালের মতো বিভিন্ন ধরনের ডাল অন্তর্ভুক্ত করা পুষ্টি গ্রহণকে বৈচিত্র্যময় করবে।
শাকসবজি
বাংলাদেশের উর্বর জমিতে পালং শাক, লাউ, বেগুন এবং ঢেঁড়সের মতো বিভিন্ন শাকসবজি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। ড্যাশ ডায়েট প্রতিদিন ৪-৫ বার শাকসবজি খাওয়ার পরামর্শ দেয়। তবে বাংলাদেশের রান্নায় প্রচুর তেল ব্যবহার করা হয়, যা শাকসবজির পুষ্টিগুণ নষ্ট করে। কম তেলে রান্না বা সেদ্ধ করার মাধ্যমে শাকসবজির পুষ্টিগুণ ধরে রাখা সম্ভব।
ফল
বাংলাদেশে কলা, পেঁপে, আম এবং পেয়ারার মতো ফল সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। এগুলো পটাশিয়ামে সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। প্রতিদিন ৪-৫ বার ফল খাওয়া ড্যাশ ডায়েটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মাছ
বাংলাদেশের মিঠা পানির মাছ যেমন ইলিশ, রুই, এবং পাঙ্গাশ প্রোটিন এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভালো উৎস। গ্রিল বা বেক করা মাছ, যা লবণ কম ব্যবহার করে রান্না করা হয়, হৃদরোগের জন্য স্বাস্থ্যকর।
সোডিয়াম গ্রহণ: একটি বড় পরিবর্তন
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারে লবণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। ড্যাশ ডায়েট প্রতিদিন ২,৩০০ মিলিগ্রামের কম এবং উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ১,৫০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম গ্রহণের পরামর্শ দেয়। এজন্য প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে চলা, তাজা খাবার গ্রহণ এবং লেবুর রস, মশলা ব্যবহার করা যেতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
ড্যাশ ডায়েট বাস্তবায়নে গ্রামীণ ও নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা এবং টাটকা খাবার পাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এসব এলাকায় সরকার ও এনজিওগুলোর মাধ্যমে তাজা শাকসবজি সহজলভ্য করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ড্যাশ ডায়েট স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য একটি নমনীয় এবং কার্যকর পদ্ধতি। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক: রাইসা মেহজাবীন, শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগ
গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স।