মাহবুবুল হক খান, দিনাজপুর প্রতিনিধি: দিনাজপুরে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গোৎসব সমাপ্ত হয়েছে। এর আগে শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিনে শনিবার জেলার প্রতিটি মন্ডপে মহানবমী ও রবিবার বিজয়া দশমী পূজা সম্পন্ন হয়। পূজার শেষ দিনে শহরের মন্ডপগুলো ঢাক-ঢোল, কাঁসর ঘণ্টা, শাঁখের ধ্বনি ও ধূপের ধোঁয়া, আর ভক্তিমন্ত্রে মূখর হয়ে ওঠে। সেই সাথে বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জায় উদ্ভাসিত হয়েছিল পূজামন্ডপগুলো।
এই দিনেই দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক (পৃথিবী) ছেড়ে ফিরে যাবেন স্বামীগৃহ কৈলাসে। দেবী দুর্গার বিদায়ে মন্ডপে মন্ডপে ছিল বিষাদের ছাযা। উলুধ্বনি, শঙ্খ, ঘণ্টা আর ঢাকঢোলের বাজনায় ছিল দেবীদুর্গার বিদায়ের সুর।
গত ৯ অক্টোবর ২০২৪ মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শারদীয় দুর্গাপূজা। আর ১৩ অক্টোবর ২০২৪ বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শারদীয় দুর্গাপূজার। সনাতন ধর্মাবলম্বি সম্প্রদায়ের লোকেরা গত ৫ দিন হাসি-আনন্দ আর পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন।
রবিবার (১৩ অক্টোবর-২০২৪) বিকেল ৪টার পর বাসুনয়াপট্টি কেন্দ্রীয় মন্দিরসহ শহরের ৪৪টি পূজামন্ডপ থেকে প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের জন্য বিজয়া শোভাযাত্রা করে দিনাজপুর শহরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত পূর্ণভবা নদীর চাউলিয়াপট্টি সাধুরঘাট এলাকায় যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে একে একে নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। রাত ৭টায় প্রতিমা বিসর্জন দেয়া শেষ হয়।
রীতি অনুযায়ী, সদবা নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় দশমীর দিন সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দেবীদুর্গাকে সিঁদুর ছোঁয়ান। দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর সেই সিঁদুর প্রথমে সিঁথিতে দিয়ে পরে একে অন্যের সিঁথি ও মুখে ছোয়ান। মুখ রঙিন করে হাসিমুখে দেবীদুর্গাকে বিদায় জানান, যা সিঁদুর খেলা নামে পরিচিত।
পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবীদূর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীসহ মর্ত্যলোক (পৃথিবী) থেকে কৈলাসে স্বামীর গৃহে ফিরে যাবেন। এর আগে মহালয়ায় তিনি মর্ত্যলোকে (পৃথিবীতে) পিতৃ গৃহে আগমন করেন। আসুরিক শক্তির বিনাশ আর শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি লাভের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে দেবী দূর্গার আরাধনা করে আসছেন।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার দেবীদুর্গা মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছেন গজে (হাতিতে) চড়ে। শান্তি, সংহতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আসুরিক শক্তির বিনাশকল্পে বিশ্বব্যাপী মঙ্গল বার্তা নিয়ে দেবীদুর্গা এ সময়ে লোকালয়ে আসেন। গজে চড়ে দেবীর আগমনের অর্থ হলো শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। মনে করা হয়ে থাকে, দেবী যদি গজে চড়ে মর্ত্যলোকে আসেন তাহলে তিনি সঙ্গে করে সুখ, সমৃদ্ধি নিয়ে আসেন। হাতি হচ্ছে জ্ঞান ও সমৃদ্ধির প্রতীক। আর বিজয়া দশমীতে দেবী মর্ত্যলোক ছাড়বেন নৌকায় চড়ে। নৌকায় চড়ে মর্ত্য ছাড়লে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। পৃথিবী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা। কিন্তু সেই সঙ্গে অতি বর্ষণ বা প্লাবনের আশঙ্কাও দেখা দেবে।
বিজয়া দশমি উপলক্ষে দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি'র নেতৃত্বে বিএনপির নেতাকর্মীরা সনাতন ধর্মের লোকদের স্বাগত জানান। এ সময় বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল ও অন্যান্য অঙ্গসহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
অন্যান্য বারের ন্যায় এবারে দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত হিন্দু-মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোর ছুটে আসে প্রতিমা বিসর্জন দেখতে। এ সময় শহরের মডার্ণ মোড় থেকে চাউলিয়াপট্টি সাধুরঘাট পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশ দর্শণার্থীদের পদচারনায় ভরে উঠে। ওই রাস্তার দু’পাশে অস্থায়ী দোকানীরা বিভিন্ন খাবারের দোকান, বাচ্চাদের খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রীর দোকান সাজিয়ে বসেন। প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য দেখতে আসা দর্শণার্থীরা এসব খাবারসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনে নিয়ে বাড়ী ফিরে যায়।
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিমা বিসর্জনের সময় সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়।পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল প্রতিমা বিসর্জনের সময় সাধুরঘাট এলাকায় অবস্থান করেন। এছাড়া দিনাজপুর পৌর বিএনপি'র ২ নম্বর ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডসহ অন্যান্য ওয়ার্ডের বিএনপি নেতাকর্মীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। বিএনপির নেতাকর্মীদের তদারকি করেন পৌর বিএনপির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়া, সাধারণ সম্পাদক মন্ডল বকুলসহ পৌর বিএনপির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
অপরদিকে প্রতিমা বিসর্জনের সময় দিনাজপুর সদর সার্কেলের এএসপি মোঃ মামুন আল জিন্নাহ, কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জসহ পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, ২ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর কাজী আশরাফউজ্জামান বাবু, সাবেক মহিলা কাউন্সিলর হাসিনা বেগম, দিনাজপুর পৌর বিএনপি'র ২ নাম্বার ওয়ার্ডের সভাপতি বাদল দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম শামীম, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দল দিনাজপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইমরুল হাসান রাজিবসহ বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া দিনাজপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার রায়, কোষাধ্যক্ষ বাচ্চু কুমার কুন্ডু, বাংলাদেশ ইন্দ্র বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্ট দিনাজপুর জেলা শাখার আহবায়ক উত্তম কুমার রায়সহ কল্যাণ ফ্রন্টের স্বেচ্ছাসেবক দল, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বিকেল ৪টা থেকে প্রতিমা বিসর্জনের শেষ সময় রাত ৮টা পর্যন্ত সাধুরঘাট এলাকায় অবস্থান করেন।
উল্লেখ্য, দিনাজপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের দেয়া তথ্যানুযায়ী এবারে জেলার ১৩টি উপজেলায় ১২০৮টি মন্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৬৫টি মন্ডপে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হবে। বীরগঞ্জ উপজেলায় ১৫৩টি, কাহারোলে ১০৯টি, বিরলে ৯৭টি, বোচাগঞ্জে ৮৩টি, চিরিরবন্দরে ১৫৬টি, খানসামায় ১৩৫টি, ফুলবাড়ীতে ৬৫টি, বিরামপুরে ৪২টি, নবাবগঞ্জে ৭৩টি, হাকিমপুরে ২১টি ঘোড়াঘাটে ৪০টি ও পার্বতীপুর উপজেলায় ১৪৮টি মন্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
এমআই