মোঃ ইমরান মাহমুদ, জামালপুর প্রতিনিধি :
খাদ্য বিভাগের সামান্য শ্রমিক ঠিকাদার থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সুরুজ্জামান। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শ্রমিক ঠিকাদার সুরুজ্জামানকে তার ভক্ত, অনুসারী ও অনুরাগীরা ‘বস জামান’ আরও নানা বিশষণে বিশেষায়িত করতেন।
কারণ তিনি রাজনীতিতে নিজ দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে কু-বুদ্ধি দেওয়ার মাস্টার মাইন্ড হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বোমা বানানো ও বিরোধী দলের ওপর তা-প্রয়োগে খুবই একজন দক্ষ মানুষ ছিলেন তিনি। তাই তাঁকে অনেকেই ‘বোমা জামান’ হিসেবে সম্বোধন করেন। এভাবেই তিনি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একজন গডফাদার হয়ে যায়।
তাঁর নিজের এলাকা বন্দেরবাড়ী, মুকন্দবাড়ি, দড়িপাড়া, মালগুদাম রোড, স্টেশন রোড ও গেইটাপাড়ে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতির কু-বুদ্ধির নীতিনির্ধারকও ছিলেন তিনি।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিংহজানি খাদ্য গুদাম, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন জামালপুর, জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড, জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ তাঁর এলাকার সব অফিস এককভাবে নিয়ন্ত্রন করতেন তিনি। এলাকায় জমি দখল, রেলওয়ের জমি দখল, বালু ব্যবসা, বিভিন্ন কাজের পার্সেন্টেজ, জমির ব্যবসা, নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারি ও ভূয়া রাইস মিল দেখিয়ে ধান-চালের বরাদ্দ নিয়ে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছে তিনি।
পৌর শহরের মালগুদাম রোডে জমি জবর দখলের বিষয়টি জানিছেন বিএনপির নেতা মোহাম্মদ মোকছেদুর রহমান হারুন। হারুন বলেন, মালগুদাম রোডে প্রায় ৪৫ শতাংশ জমি কয়েকজনে মিলে কিনেছিলাম। জামান সেই জমিতে যেতে আমাদের বাঁধা দেয়। এ সময় তিনি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ১৩ শতাংশ জমি জোড়পূর্বক দখল করে। ওই জমির কোন কাগজপত্র তার নেই। এখন ওই জমির দাম ২ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে।’
এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাকালীন সময়ে রেলের জমি ইজারা নিয়ে ৪ পুকুর, বিএডিসির প্রায় ২ একর জমিতে পুকুর ও ছোট গুদাম ঘর, মুরগী ও গরুর খামার নির্মান করেছেন। নিয়ন্ত্রন করতেন বিএডিসির বীজ কেন্দ্রের শ্রমিক ও বীজের সকল ব্যবসা। এখান থেকে তিনি পেতেন পার্সেন্টেজ। সিংহজানী খাদ্যগুদামের মাল লোড-আলোডের শ্রমিক ও সকল ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন ছিল জামানের। রাইস মিলের মালিক না হয়েও ভুয়া মালিক সেজে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে ধান চাল বরাদ্দ নিতেন এবং অফিস নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার কারনে বিএডিসির অনেক পুরানো ব্যবসায়ীরা ছেড়ে দিয়েছেন ব্যবসা।
শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন সুরুজ্জামান। প্রভাষক হিসেবে যোদান করলেও তিনি নিজেকে অধ্যাপক পরিচয় দিতেন। এখানেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। কলেজের পুরো নিয়ন্ত্রণ তার কব্জায় নিতে শুরু করেন একের পর এক ষড়যন্ত্র। কলেজের বিরুদ্ধে করেন মামলা। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয় তৎকালীন অধ্যক্ষকে। পরে ২০১৯ সালে কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন সুরুজ্জামান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, ‘তিনি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কলেজে দলীয় প্রভাব দেখাতেন তিনি। তিনি প্রভাষক হয়েও নিয়মবর্হিভুত ভাবে নিজেকে অধ্যাপক পরিচয় দিতেন। যেটা করার তাঁর কোন এখতিয়ার নেই।’
কলেজের পদ হারিয়ে আস্তানা গাড়েন প্রেসক্লাবে এবং স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসে। সেই পত্রিকার সম্পাদকের পরার্মশে নিজের সকল অপর্কম ডাকতে কৌশলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে একটি দৈনিক পত্রিকার অনুমোদন নেন তিনি। সেই পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয় নাই। পত্রিকার নিবন্ধন ধরে রাখতে মাঝে মধ্যে রেব করতেন। এই পত্রিকার নামেই তার প্রেসক্লাবে আগমন। তার কু-পরার্মশে জেলার প্রথম সারি বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে ক্লাব থেকে বহিস্কার হতে হয়। এরপর ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। তার নিয়ন্ত্রণে একটি ক্লাবের সাংবাদিকরা থাকায় নিজ দল থেকে নিতেন অনৈতিক সুবিধা। ওই পত্রিকার নাম ভাঙিয়ে কিছু অসাধু সাংবাদিক নেতার সহযোগিতায় অবৈধভাবে বা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবেও। ওই ক্লাবটিকে তিনি তাঁর নিজস্ব বা দলীয় কার্যালয়ের মতো ব্যবহার করতেন। শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেই থেমে যাননি। নিজ দলের বিরুদ্ধে লেখালেখিতে তার ফেইসবুক সব সময় সরব থেকেছে।’
প্রেসক্লাব জামালপুরের সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রেসক্লাব ছিল জামানের নিজস্ব অফিস। সকালে এসে বসতেন দুপুরে চলে যেতেন। আবার সন্ধ্যায় আসতেন গভীর রাতে চলে যেতেন। এ সময় তিনি ক্লাবে বসে তার দলীয় লোকজন নিয়ে রাজনৈতিক, ঠিকাদারী, দখলদারী, সরকারি খাদ্যগুদাম ও বিএডিসি অফিস নিয়ন্ত্রনসহ নানা অপকর্ম করতেন। তাঁর কু-পরমর্শে ক্লাবের কয়েকজন সাংবাদিককে বহিস্কার করা হয়েছে। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়। মামলা চলমান থাকাবস্থায় কমিটির সহ-সভাপতি মারা গেলে অগঠনতান্ত্রিকভাবে তিনি সহ-সভাপতি হন। যা গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। এরপর আমরা ওই ক্লাব থেকে বের হয়ে এসে নতুন ক্লাব গঠন করেছি।’
এভাবে নানা অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে শ্বশুড়বাড়ী দড়িপাড়া টাইঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গড়েছেন বিলাসবহুল ৫ তলা বাড়ি। ওই বাসস্ট্যান্ডে তার আরও রয়েছে বেশ কয়েকটি দোকান। সেই দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছেন। ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেই ফ্ল্যাটে তার মেয়ে থাকেন বলে জানা যায়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকাতে রয়েছে নামে বেনামে জমি।
বন্দেরপাড়া গ্রামের সুজন বলেন, ‘এই ১৬ বছর এলাকার মানুষ জামানের ভয়ে টু শব্দ করতে পারেনি। তার ভয়ে মসজিদেও কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। তিনি খাদ্য ও বিএডিসি অফিস এককভাবে নিয়ন্ত্রন করতেন। এই অফিসগুলো থেকে তাকে কমিশন দিতে হতো। তিনি রেলের ও বিএডিসির জমি দখল করে পুকুর, গোডাউন ও খামার দিয়েছেন। এসব করে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক।’
জামালপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক তারিক মালেক সিজার বলেন-‘জামান একটি নোংরা লোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি জাসদ করতেন। তখন তিনি ককটেল বানাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেন। লেখাপড়া শেষে জামালপুর এসেও তিনি ৯০ সালের দিকে জাসদের মিছিল করেছে। আমরা দেখেছি। সেই সময় জামালপুর শহরের কোনো মারামারিতে বোমা বা ককটেলের প্রয়োজন হলে তাকে ডাকা হতো। তিনি সবসময় ককটেল সাপ্লাই দিতেন। এভাবেই তার নাম হয়ে উঠে বোমা জামান। তার কুকর্ম আর কুবুদ্ধি দিয়ে তিনি ৯০ দশকের অনেক নেতাকে পিছিয়ে ফেলে এক সময় জামালপুর শহরের জামান বস হয়ে উঠে। তিনি মূলত আওয়ামী লীগের কলঙ্ক।’
এ জেলা দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘যারা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দূর্নীতি ও অনিয়ম করে সম্পদ অর্জন করেছে তাদের সম্পদ জব্দ করাসহ অবৈধ সম্পদ উপার্জনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহনের দাবি জানিয়েছেন তিনি।’
উল্লেখ্য, গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের এই নেতা আত্ম-গোপনে চলে গেছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারে সময়ে গেইটপাড় এলাকায় বিএনপির কর্মসূর্চী পালন করতে গিয়ে কয়েক দয়া হামলা শিকার হয়েছেন। যে হামলার নেতৃত্বও দিয়েছেন জামান বস বা বোমা জামান।
সময় জার্নাল/এলআর