মো. শামছুল আলম ::
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। কোনো ধরনের আপোসের পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজীরবিহীন। শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্ববোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি। এ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী। এ ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর কাব্যিক গুণ-শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস, যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও চতুর্দিকে অনুরণিত। যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই উত্থিত হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তা তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও ছিল তাই, যা লিখিত ছিল না। এ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি আকারে ছিল নাতিদীর্ঘ।
১৯৭১ সালের এই দিনে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শোনান। এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'' তিনি বলেন, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআলাহ!''
কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে। আর বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন কবি হিসেবে। তিনি তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতার শেষাংশে লিখেছেন,
‘‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে,
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন,
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা,
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?,
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি;
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'৷''
কবি নির্মলেন্দু গুণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘শুধু আমিই যে বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছি, তা কিন্তু নয়৷ পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে বলেছে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স'৷ তাঁর ভাষণ শুনে নিউজ উইক তাঁকে পোয়েট অব পলিটিক্স বলেছে, কারণ, তাঁর ভাষণে শব্দয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো।''
নির্মলেন্দু গুণ আরও বলেন, ‘‘একজন কবি মানুষের মনের কথা বললেন কিনা তা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ তিনি কিভাবে বলেন, কোন ঢংয়ে বলেন, তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ মাইকেল মধুসূদন দত্ত'র মেঘনাধবধ কাব্য মানুষের মনের কথা নয়, তবে বলার ঢংয়ে তা মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে৷ আর বঙ্গবন্ধু'র ভাষণে তাঁর নাটকীয়তা এবং সম্মোহনী কথা বলার স্টাইল ছাড়াও যুক্ত হয়েছে মানুষের মনের কথা বলার বিষয়টি৷ তিনি ৭ মার্চের বক্তৃতায় মানুষের মনের কথা বলেছেন৷ আশার কথা বলেছেন৷ আর সে কারণে এখনো তাঁর সেই বক্তৃতা মানুষকে উজ্জীবিত করে৷ পৃথিবীর কোনো নেতা ১০ লাখ মানুষের মাঝে এরকম উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই৷ আজো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে তাঁর ভাষণ বেঁচে আছে৷ থাকবে৷ তাই এটা অমর কবিতা৷ আর সেই কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।''
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নানা দিক বিশ্লেষণ করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ৷ তাঁর বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুরর ৭ মার্চের ভাষণের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর সেগুলো হলো: ১. বাঙালির সংগ্রাম ঐহিত্য এবং বঞ্চনার ইতিহাস, ২. গণতান্ত্রিক চেতনা, ৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, ৪. শান্তির বাণী, ৫. মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ৬. আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ৷
তিনি বলেন, ‘‘এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন৷ কিন্তু তা সহিংস নয়৷ তিনি শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথা বলেছেন৷ অহযোগের কথা বলেছেন, আবার সবাইকে মাসের এক তারিখ গিয়ে বেতন আনতে বলেছেন৷ তাঁর এই একটি বক্তৃতা একটি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছে৷ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে৷ আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম হয়নি৷ একটি ভাষণেই পুরো দিক নির্দেশনা ছিল৷ একটি ভাষণের এই অর্জন এবং গুণাবলী বিশ্বের আর কোনো ভাষণের আছে বলে আমার জানা নাই৷''
‘‘বিশ্বজনীনতা এবং মানবিক গুণের কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে৷ তিনি যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে কথা বলেনছেন এটা সারাবিশ্বের সব মানুষের অধিকার৷ তাই সারবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতা-বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন৷ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানুষের সার্বজনীন অধিকার৷''
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো৷''- এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷ তিনি বলেছেন, এই বাংলায় হিন্দু বা মুসলমান, বাঙালি বা অবাঙালি সকলেই এ দেশের সন্তান, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব হলো জনগণের৷ তিনি পার্টির নেতা-কর্মীদের বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয়৷
অধ্যাপক হারুন বলেন, ‘‘এটা তাঁর মানবিকতা এবং অসাম্প্রদয়িক চরিত্রের প্রকাশ৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘৭ই মার্চের ভাষণের বড় শিক্ষা হলো কোনো জাতিকে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না৷ বন্দুকের নল বা অস্ত্রের মুখে ‘দাবায়ে' রাখা যায় না৷ এটাই বিশ্বজনীন সত্য৷''
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই স্বীকৃতি৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন৷ বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র৷ কালজয়ী এই ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে৷ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি৷ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ছিনিয়ে আনি মহান স্বাধীনতা, বাঙালি জাতি পায় মুক্তির কাঙ্ক্ষিত স্বাদ৷ প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ৷''
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড-এর বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি' বইয়ে এই ভাষণ স্থান পেয়েছে৷
লেখক : সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা।