শরীফা উম্মে শিরিনা
* ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশে ঘটনার অন্ত নেই। তার মধ্যে ২০১৭ সাল ছিল একটি ঘটনা বহুল বছর। সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বিরোধীতা করে লং মার্চ (১০ মার্চ), রাঙ্গামাটি তে পাহাড় ধস (১৩ জুন), বাসে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার টাঙ্গাইলের জাকিয়া সুলতানা রূপা (২৫ আগস্ট), সুপ্রিম কোট কর্তৃক ১৬তম সংবিধান সংশোধন বাতিল রায় (১লা আগস্ট), উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা (১২ আগস্ট), রোহিঙ্গা সংকট শুরু (২৫ আগস্ট), সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ছুটি ও পদত্যাগ (১০ অক্টোবর ও ১১ নভেম্বর) এবং সর্বশেষ ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর কর্তৃক ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ স্বীকৃতি। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এগুলোই ছিল সবচেয়ে আলোচিত। অগণিত নেতিবাচক ঘটনার মধ্যে এক টুকরো আনন্দের স্ফূলিঙ্গের মতো ৭ মার্চের ভাষণের বৈশ্বিক স্বীকৃতির খবর আমাদের উদ্বেলিত করে। এতদিন ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বাঙ্গালি জাতির মুক্তির, গর্বের ও ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ছিল। কিন্তু ইউনেস্কোর এ স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতির এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বৈশ্বিক চরাচরে এর অবস্থান এবং সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত- নিগৃহীত জাতির মুক্তির সনদে পরিণত হওয়ার ট্রেড মার্ক পেয়েছে এ ভাষণ। এখন এ ভাষণ থেকে সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ অনুপ্রাণিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১২টি ভাষায় অনূূদিত হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ। তবে আমি স্বল্প পরিসরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যোগাযোগের ধরণ তথা কমিউনিকেশন প্যাটার্ন নিয়ে আলোচনা করতে চাই। গণযোগাযোগের তাত্ত্বিক কাঠামো দিয়েও যে ৭ মার্চের ভাষণ ব্যাখ্যা করা যায় সেটি আলোচ্য বিষয়।
এ ভাষণে ‘মার্শাল ল’ বা সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনী তথা সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেয়া, গণহত্যার বিচার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা- এ চারটি মূল বিষয়বস্তু ছাড়াও এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার বার্তা জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়া এবং এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত রাখা। ‘মিডিয়াম ইজ দ্য ম্যাসেজ’ অর্থাৎ ‘মাধ্যমই বার্তা’ যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি প্রবাদ প্রতীম বাক্য যার প্রবক্তা কানাডিয়ান যোগাযোগবিদ মার্শাল ম্যাকলুহান। তাকে রহস্য মানব বলা হয় কারণ তিনি তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেননি। ‘মাধ্যমই বার্তা’ বাক্যের দ্বারা বুঝানো হয় গণমাধ্যমের আধেয় বা তথ্য গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং মাধ্যমটাই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, সমকাল বা চ্যানেল আই কি তথ্য দিল সেটার চেয়ে এখানে সমকাল পত্রিকা পড়া বা চ্যানেল আই দেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন ম্যাকলুহান। গণমাধ্যম বিষয়ক ম্যাকলুহানের এ তত্ত্ব বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাই হয়েছে। বরং এক্ষেত্রে বলা যায় ‘ম্যাসেজ ইজ দ্য মিডিয়াম’ অর্থাৎ, ‘মাধ্যম নয়, বার্তাই মুখ্য’। কারণ সেদিনের ভাষণ কোন রেডিও বা কোন টেলিভিশনে প্রচার হলো এবং কোন পত্রিকায় সম্প্রচার হলো সেটা মূখ্য বিষয় ছিল না; বরং ভাষণ শোনা বা পড়া যাচ্ছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমনকি এখনো ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রে মাধ্যমের চেয়ে তার বার্তাই মূখ্য বিষয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে অজ্ঞাতসারেই ‘ম্যাসেজ ইজ দ্য মিডিয়াম’-এই তত্ত্বের ধারণার দাবিদার বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে, গণমাধ্যমের ‘এজেন্ডা সেটিং’ (আলোচ্যসূচি নির্ধারণ) তত্ত্ব দিয়েছেন দুই যোগাযোগবিদ ম্যাক্সওয়েল ম্যাককম্বস ও ডোনাল্ড শ। এ তত্ত্বের আবির্ভাব ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ‘গণমাধ্যম জনগণের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে দেয়’- এটি এ তত্ত্বের মূল কথা। অর্থাৎ, জনগণ কি নিয়ে চিন্তা করবে, কি নিয়ে কথা বলবে সেটা গণমাধ্যম ঠিক করে দেয়। অবশ্য পরবর্তীতে এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বকে মিডিয়া এজেন্ডা (গণমাধ্যমে যেসব বিষয় আলোচিত হয় ও গুরুত্ব পায়); পাবলিক এজেন্ডা (জনগণের মধ্যে যে বিষয়গুলো বহুলভাবে আলোচিত হয় ও যে বিষয়গুলোকে জনগণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে) এবং পলিসি এজেন্ডা (রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক বা আইনপ্রণেতারা যে বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে)-এই ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে (সামিন, মাধ্যম চিন্তা: ২০১১)। এ তত্ত্বকেও চ্যালেঞ্জ করে ৭ মার্চের ভাষণ। যদিও মার্কিন নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে আর জাতির জনক শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণ দেন ১৯৭১ সালে। তাত্ত্বিকরা মার্কিন নির্বাচনের পরিবর্তে এ ভাষণ নিয়ে কাজ করলে হয়তো আমরা এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের উল্টো চিত্র দেখতে পেতাম। সেক্ষেত্রে ইন্ডিভিজ্যুয়াল এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব পেতাম। অর্থাৎ, গণমাধ্যম নয়, বরং ব্যক্তি গণমাধ্যমের এজেন্ডা তথা আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে দেয়- এ ধরণের একটি তত্ত্ব আসতে পারত। তবে এখনো এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের মিডিয়া, পাবলিক ও পলিসি এজেন্ডার সাথে ইন্ডিভিজ্যুয়াল এজেন্ডাও আলোচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমের উপর প্রভাব বিস্তারকারী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছাড়াও বিশ্বের জগৎ বিখ্যাত ভাষণসহ ভবিষ্যৎ ভাষণ এর আলোকে ব্যাখ্যা করা যাবে। বঙ্গবন্ধু একজন দূরদর্শী যোগাযোগবিদ ছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধী’র অহিংস এবং নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসু’র সহিংস আন্দোলনের দর্শন একত্রিত করতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেছেন এভাবে, ‘...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি স্বাধীনতার কথা আগে বলতে পারতেন কিন্তু বলেননি। কারণ তিনি জানতেন স্বাধীনতার চেয়ে মুক্তিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যার কারণে তিনি মুক্তির কথাই আগে উচ্চারণ করেছেন। তিনি এও জানতেন যে মুক্তির সংগামের শেষ নেই। স্বাধীনতার পরও মুক্তির সংগ্রাম করতে হবে আমাদের যার জন্য তিনি মুক্তির সংগ্রামের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। আমাদেরকে এখনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ক্ষুধা ও দারিদ্র থেকে মুক্তি পেতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সার্বিক দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, যোগাযোগের ছাত্র না হয়েও বঙ্গবন্ধু একজন সফল যোগাযোগবিদ ছিলেন। উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী ও সুবাস চন্দ্র বসুর যোগাযোগ দর্শন (কমিউকেশন ফিলোসফি) নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে কেন বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ দর্শন (কমিউকেশন ফিলোসফি) নিয়ে গবেষণা হবে না? স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেখা যায় জাতীয় দিবস গুলোতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুধু মাইকে বাজানো হয়। এতে করে জাতির পিতার আদর্শ কতুটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে তা গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। বরং নতুন প্রজন্ম যাতে বঙ্গবন্ধু আদর্শকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে সেজন্য ব্যাপক পরিসরে তাঁকে নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। সেই সাথে গবেষণা হওয়া দরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা জাতীয় নেতৃবৃন্দ যেমন- তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এম এ জি ওসমানী সহ ফোর্স ও সেক্টর প্রধানদের নিয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষে উৎসব পালনের আরম্বর নয়; বরং তাঁর আদর্শ ধারণ করে অর্পিত স্ব স্ব দায়িত্ব পালনই হবে শ্রেষ্ঠ উপহার।
শরীফা উম্মে শিরিনা
চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
(বি. দ্র. লেখাটি ২০২০ সালে রুদ্র সাইফুল সম্পাদিত একাত্তর প্রকাশনা থেকে ‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক গ্রন্থে প্রকাশিত।)
সময় জার্নাল/