ইমরান মাহফুজ ::
গুণ বেগুণে পাল্টায় সময়। যেমন হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের সাথে পাল্টাচ্ছে উন্নয়নের মডেলম্যাপ। নিদারুণ বেদনার বিষয় হচ্ছে উন্নত হচ্ছে না চিন্তার ধরণ ধ্যান জ্ঞান- রুচিবোধ। দেশপ্রেমর অভাব কাল থেকে কালান্তর। আর সাহিত্য শিক্ষা সাংবাদিকতার দূরাবস্তার কথা ভাবুকমাত্র জানেন। আমার এইসব ভাবনার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন এক যুগ আগে দৈনিক ফেনীর সময়। পত্রিকাটি বের হবে সেই মুহূর্তে ৩ দিনের কর্মশালার আয়োজন করেন সম্পাদক প্রকাশক শাহাদাত হােসেন। মুগ্ধ হন সবাই। সম্পাদকের পাশে সে সময় পাশে ছিলেন জেলা তথ্য অফিসার মাহবুবুর রহমান, কবি মনজুর তাজিম, কবি মাহবুব আলতমাস সহ আরো অনেকে। আমায় নিয়ে যান কবি রাশেদুল হাসান।
ফেনীর সময়ের কর্মশালার আগ অব্দি জানা ছিলো না সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি, পড়াশোনার দরকার। তিন দিনে অনেক জানার ইংগিত পেলাম। সম্পাদক অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি আলোকিত ফেনী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিক্ষা, সামাজিক এবং সাস্কৃতিক ক্ষেত্রে নানা মূখি অবদান রেখে এক অনন্য নজির স্থাপন করে ছিলেন। সেই সাথে সংবাদ পরিবেশনার গুরুত্ব, স্থানীয় সমস্যা তুলে ধরা ও সমাধানের পথ নির্দেশনা দেয়ায় সবার কাছে গ্রহনযোগ্যতা বলার মতো।
সেই পাঠে কাজ করলাম প্রায় এক বছর। পত্রিকাটি ব্যাপক সাড়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। নিরপেক্ষতা, পরিবেশনার ও উপস্থাপনায় মফস্বলের খবরের চেহারা পাল্টে দেয়। এর মধ্যে আমি চলে যাই আজব শহর ঢাকায়। তবে কুমিল্লার ছেলে ফেনীর অনুপ্রেরণার ঢাকায় আমিও প্রায় এক যুগ। কত স্মৃতি কত গল্প। জীবনের পাঠশালার নতুন এক অধ্যায়। সেই প্রেক্ষিত এবং সেই সময়ে নয়া দিগন্তে চলার বীজ রুয়ে দিয়েছেন ফেনীর সময়। সেই সবুজে আমার জীবন। সেই আগুনে আজও চলছি পিছঢালাপথে। নগরীর বাইরের এক শিখা শাহাদাত ভাই। যার প্রেরণায় ইমরানরা মাহফুজ হয়ে উঠে। কুয়াশা সরিয়ে সকালের আলো দেখে। দ্বিধা শংসয় কাটিয়ে বাড়ে তারুণের আগুন।
পথ চলতে চলতে গিয়ে বুঝেছি সমস্যা পথচারির না পথের। মানুষ চাইলে বিশেষ করে সাংবাদিকরা চাইলে সাহিত্য সংস্কৃতি শিক্ষার সমাজে নতুন আলো ফেলতে পারে। ফেনী ছোট শহর থেকে শাহাদাত ভাইয়ের বাতি চারদিক আলোকিত করে চলছে। তার সহকর্মীরা আন্তরিকতায় কাজ করে চলছে। দিনের পর দিন রাতকে দিন বানিয়ে কাজ করেছে। তুলে এনেছে অজানা অধ্যায়। মানুষের জানার অধিকার থেকে খবর প্রকাশ করে আস্থার প্রতীক নির্বাচিত হয়েছে। না হয় মরার দেশে খররা শহরে একটা দৈনিক টিকিয়ে রাখা সহজ না। মা মরা সন্তান লালন করার মতো।
হামলা মামলা হুমকির বাইরে বিজ্ঞাপনহীনতা তো লেগে থেকে সম্পাদক কিংবা প্রকাশকের। তাদের জ্বালা কেউ কী জানে। কেউ কেউ জানে। তবু সকালের একজন পাঠকের হাসি উচ্ছ্বাস তাঁর চলার শক্তি জোগায়। অন্যদিকে এক প্রতিবেদনে উঠে আসে ২০২০ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ১৭২টি মামলার মধ্যে ৭০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট ৬৩টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয় ৮৬ জনকে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে আট জন সাংবাদিক। এছাড়া অজ্ঞাত আরো ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৫০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা। সাংবিকদের জন্য কয়জন রাস্তায় নামে? সাধারণ মানুষের জন্য একজন লেখক সাংবাদিক কাজ করেন, তারাই বিপদে পড়লে কয়জনকে দেখা যায়। কিন্তু একটু ভুল হলে দিল্লীরকোর্ট দেখাতে ব্যস্ত জনগণ।
খ.
বাংলাদেশের সংবিধান মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু তিক্ত সত্য- সেটা শর্তসাপেক্ষ এবং আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। সাথে নন স্টেট ফ্যাক্টরের মধ্যে মালিক পক্ষও আছে। তারা যদি সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ফেলে দেন, তাহলে কিন্তু সাংবাদিক স্বাধীন নয়। সেখানে সম্পাদকও অসহায় হয়ে পড়তে পারেন। শাহাদাত ভাই হয়েছেন প্রতিহিংসামূলকভাবে। (২০১৯ সালে ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় ফেনী থেকে প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারের রোষাণলে পড়েছেন ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিকরা) খবর সংগ্রহের পাশাপাশি কোর্টে হাজির হয়েছেন কার জন্য? সে এক ভিন্ন অধ্যায়...
আমাদের দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বেশ কিছু ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়েছে। তা সবাই জানেন। সুতরাং দ্রুত আইনটি পরিবর্তন করা দরকার। কে করবে? কেউ নেই মুক্তচিন্তার মানুষের? কেউ কী নেই দেখার জানার বোঝার। মানুষ মাত্র জানেন আইন পাথরে খোদাই করা কোনো বিষয় নয় যে, তা পরিবর্তন করা যাবে না। সরকার চাইলেই তা পরিবর্তন করতে পারে। তাই হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করতে হবে অথবা আইনের অস্পষ্ট বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়নে বিধি প্রণয়ন করতে হবে। বিশেষ করে এই আইনটা কতটা তথ্যপ্রকাশবান্ধব হবে, তা নির্ভর করবে নাগরিক সমাজের ভূমিকার ওপর। আর তা নিশ্চিত হলেই স্বাধীন দেশে সামাজিক আসবে। না রাষ্ট্রের ৫০ বছর ১০০ বছর হলেও সামাজিক মুক্তি আসবে না- হাহাকার করবে স্বাধীনতা।
এই যে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, রাজধানীকেন্দ্রিক, সরকারকেন্দ্রিক এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক চরিত্র গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের, মিডিয়ার, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে তা সুখসংবাদ নয় অবশ্যই। ডেকে আনবে দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা। তবে আমাদের ঢাকা, ঢাকার বাইরের সমস্যা অনেক- সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক; এবং সবে মিলে একটি বৃহত্তর নৈতিক।
যদি আমাদের সংবাদমাধ্যমের কর্মপদ্ধতি ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে ওঠে, ক্ষমতাসীনের সঙ্গে তাদের গড়ে ওঠে সখ্য, শহুরে বিত্তবানরাই থেকে যায় তাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে, তাহলে গণতন্ত্রের শরীর-স্বাস্থ্যের আসল সমস্যাগুলিকে নিয়ে ভাববে কারা? নগর শহরের লাগামছাড়া বাজার ভোগবাদ আজ আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো গিলে খাচ্ছে সাংবাদিকতাকেও। ব্র্যান্ডের সঙ্গে নিজেদের জুড়ব, কিন্তু কাজের বেলায় শর্টকাটে কাজ সারব- এই প্রবণতা একদিকে যেমন নতুন প্রজন্মকে প্রথম থেকেই পঙ্গু করে দিচ্ছে, অন্যদিকে বেশি ঝুঁকির রাস্তায় না গিয়ে চেয়ার এবং বেতন সুরক্ষিত রাখতে সমঝোতার পথে চলতে গিয়ে পেশাটির বিশ্বস্ততাকেই জলাঞ্জলি দিচ্ছেন অনেক বর্ষীয়ান সাংবাদিক।
এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার পথটি দিন দিন আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠছে, আর তার সাথে সাথে শেষ হচ্ছে সৎ এবং পরিশ্রমী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ... তাই এখনি দরকার মানুষ ও সমাজের জন্য ভাবা গণমাধ্যম। অসংখ্যা অনলাইন অফলাইনের ভিড়ে সাংবাদিকতার উজ্বল সময় আসছে। দরকার কর্মশালা। সাথে সমাজ জানা বোঝার পাঠ, মানুষের মৌলিক কী কীভাবে পূরণ হয় তা ক্ষেত্র জানা। সংকটের সাথে সম্ভাবনা তুলে আনা। হোক সেটা ঢাকা কিংবা কুমিল্লা ফেনী। দরকার সমাজ নিয়ে ভাবা, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। প্রান্তের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে ফেনীর সময় এগিয়ে যাক কঠিন পথের সরলতায়। মা মাটি মানুষের হয়ে থাকুক আরেক যুগ।
লেখক : কবি ও গবেষক; সহ-সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা