ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম:
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সামরিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ নিয়ে বিভ্রান্তি, বিভাজন এবং রাজনৈতিক অপব্যবহার লক্ষ করা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকৃত অর্থ
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য এবং মানবাধিকারের ভিত্তিতে একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন। এ চেতনা কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। বরং এটি একটি জাতীয় চেতনা, যা দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একত্রিত করতে পারে।
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রায়ই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত, বিরোধী মতকে দমনে এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একধরনের 'ঐশী সত্তা' হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক।
মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা: একটি সময়-নির্ভর ধারণা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন, তারা তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতি আস্থা রাখতেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আমাদের বিজয়ের মাধ্যমে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এরপর থেকে নতুন করে 'মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা' শব্দটি ব্যবহার করা সময়ের অপচয় এবং গৃহযুদ্ধের মানসিকতা সৃষ্টির শামিল।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বা করেননি, এমনকি বিরোধিতা করেছেন—এমন ব্যক্তিরাও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। রাষ্ট্রের মালিকানা চিরকাল জনগণের।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যবহার এবং ফলাফল
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে যেকোনো রাজনৈতিক বিরোধী মত দমন করার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। এর ফলে, বিভাজনের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা জাতিকে বিভক্ত করে।
গণতান্ত্রিক সংকট
ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি' হিসেবে নিজেকে একমাত্র বৈধ দাবি করে, যা বিরোধী দলকে অযথা দুর্বল করে তোলে।
উগ্র ফ্যাসিবাদ
যখন মুক্তিযুদ্ধকে পবিত্র বা অবিসংবাদিত সত্তা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন এটি গণপিটুনি, গৃহযুদ্ধ, এবং নাগরিক অধিকার হরণের পথ খুলে দেয়।
গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকারের গুরুত্ব
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো নাগরিকের অধিকার তার রাজনৈতিক বা আদর্শিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে না। মুক্তিযুদ্ধ যারা করেননি বা বিরোধিতা করেছেন, তাদেরও সমান অধিকার থাকা উচিত।
জাতীয় সংহতি বজায় রাখতে হলে অতীতের ভুল শুধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যারা এক সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাদেরকেও গণতন্ত্রের আওতায় আনা জরুরি। ক্ষমতা চিরকাল কারও কাছে থাকে না, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ জাতি ভবিষ্যৎ গঠনের চাবিকাঠি।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের অধ্যায়, কিন্তু একে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির হাতিয়ার বানানো স্বাধীনতার মূল চেতনাকে ক্ষুণ্ন করে। জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা—সাম্য, স্বাধীনতা, এবং গণতন্ত্র—অর্থবহ করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিভাজন নয়, বরং একতার শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে সকল নাগরিকের অধিকার এবং তাদের সমান সুযোগ।
আজ আমাদের দায়িত্ব—মুক্তিযুদ্ধকে অবক্ষয়ী রাজনীতির হাত থেকে রক্ষা করা এবং এটিকে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে পুনর্গঠন করা। যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর মূল্যবান।
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, কলামিস্ট, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ।