টোব্যাকো কোম্পানীর একজন সেলসম্যান ভাবে একজন ধূমপায়ী বাড়ানো মানে তার একজন ক্রেতা বাড়লো, বিক্রি বাড়লো। আর সেই ক্রেতা মারা গেলে সে আপসোস করে- সে একজন ক্রেতাকে হারালো, বিক্রি কমে গেল বলে। অন্যদিকে আমি এবং আমার সংগঠন মনে করি এই নেশায় জড়ানো মানে একজন লোক শারীরিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। এর ফলে ক্যান্সার বা অন্যান্যে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে মনে হয়, আমাদের স্বজনদের কাউকে হারালাম। পার্থক্যটা এখানেই। যা আমাকে এই আন্দোলন আরও বেগবান করতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে অনলাইন নিউজ পোর্টাল সময় জার্নালের সঙ্গে একান্ত আলাপে এভাবেই নিজের অনুভূতি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন ‘ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ চাই সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম। কথা বলেন মাদকের হাতে খড়ি ধূমপানের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক নিয়ে। তুলে ধরেন প্রত্যাশিত ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার নানা পরিকল্পনার কথাও। এসময় সঙ্গে ছিলেন সময় জার্নালের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহ্ আলম।
সময় জার্নাল : ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ চাই সোসাইটির শুরুর উদ্দেশ্যেটা যদি বলতেন...
মো. শফিকুল ইসলাম : ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ চাই নামে একটি সংগঠন শুরু করি। এই সংগঠন শুরু করার উদ্দেশ্য ছিলো ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ গড়া। কারণ ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে পারলেই মাদক মুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। আমি লক্ষ্য করেছি যে, মাদকের শুরুটা হয় ধূমপান থেকেই। যে লোক একবার ধূমপান করে আস্তে আস্তে সে বিভিন্ন নেশায় জড়ায়। দেখে গেছে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ ধূমপান করেন। এই ৬০ শতাংশের মধ্যে আবার ৩০ শতাংশ মাদক সেবন করেন। এই মাদক সেবনের শুরুটাই কিন্তু ধূমপান দিয়ে। ধূমপান দিয়ে শুরু হিরোইন দিয়ে শেষ এরই নাম মাদক। নেশাগ্রস্তরা নেশার টাকা সংগ্রহ করতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ায়। যার ফলে একসময় সে পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর যে লোক ধূমপান করে না তার পক্ষে মাদক সেবন করা সম্ভব নয়।
সময় জার্নাল : ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ চাই সোসাইটির কার্যক্রম বর্তমানে কিভাবে চলছে?
মো. শফিকুল ইসলাম : রাজধানী ঢাকার উত্তর বাড্ডার তেঁতুল তলা রোডে আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস অবস্থিত। এখন পর্যন্ত আমরা ৬৪ জেলার সবকটি উপজেলাসহ সারা দেশে কমিটি গঠন করেছি। বিশ্বের ২৪টি দেশে আমাদের কার্যক্রম চলছে। ২ কোটি মানুষের সমর্থন নিয়ে আমাদের এই সংগঠন এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি বাংলাদেশকে মাদক মুক্ত করতে হলে সবার আগে ধূমপান মুক্ত করা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ একটি ৫তলা বিল্ডিংয়ের উপরে উঠতে হলে তার সিঁড়িটা অবশ্যয় নিচ তলায় রাখতে হবে, তা না হলে উপরে উঠা সম্ভব নয়।
সময় জার্নাল : ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা কিভাবে পেলেন?
মো. শফিকুল ইসলাম : টোব্যাকো কোম্পানীর একজন সেলসম্যান ভাবে একজন ধূমপায়ী বাড়ানো মানে তার একজন ক্রেতা বাড়লো, বিক্রি বাড়লো। আর সেই ক্রেতা মারা গেলে সে আপসোস করে- সে একজন ক্রেতাকে হারালো, বিক্রি কমে গেল বলে। অন্যদিকে আমি এবং আমার সংগঠন মনে করি এই নেশায় জড়ানো মানে একজন লোক শারীরিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। এর ফলে ক্যান্সার বা অন্যান্যে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে মনে হয়, আমাদের স্বজনদের কাউকে হারালাম। পার্থক্যটা এখানেই। যা আমাকে এই আন্দোলন আরও বেগবান করতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
সময় জার্নাল : ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ চাই সোসাইটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
মো. শফিকুল ইসলাম : আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটাই; আর সেটা হচ্ছে- ধূমপান মুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা দেশের ৬৪ জেলার প্রতিটি উপজেলা পর্যন্ত কমিটি গঠন করেছি। আমাদের এই কমিটির উদ্দেশ্য হলো কমিটিতে যারা থাকবেন তারা নিজেরা ধূমপান মুক্ত থাকবেন পাশাপাশি অন্যদেরকে ধূমপান থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করবেন। এতে আমাদের পরিবারগুলোকে আমরা ধূমপানের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করতে পারবো। নিজেরাও বেঁচে যাব।
সময় জার্নাল : সংগঠনের কার্যক্রম কিভাবে পরিচালনা করছেন?
মো. শফিকুল ইসলাম : এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী ও অরাজনৈতিক সংগঠন। এখানে সবাই নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী কাজ করছে। কমিটিগুলোর মাধ্যমে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, হাট-বাজারে সভা-সেমিনার করে মানুষকে সচেতন করতে। আমাদের সেমিনারগুলোতে মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। ধূমপান ও মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা মানুষকে নানাভাবে সচেতন করে যাচ্ছে। সরকারি সাহায্য সহযোগিতা পেলে আমাদের এই কার্যক্রমকে আরও জোরালোভাবে শুরু করতে পারতাম। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এই কার্যক্রমে সরকার সহযোগিতা করলে ২০৪১ সালে আমরা সরকারকে ধূমপান ও মাদক মুক্ত সোনার বাংলা উপহার দিতে পারবো।
সময় জার্নাল : তামাক থেকে সরকার মোটামোটি অংকের একটি ট্যাক্স পায়। সেক্ষেত্রে তামাকজাত দ্রব্য বন্ধ হলে সরকার ট্যাক্স হারাবে। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
মো. শফিকুল ইসলাম : আমাদের কোটি কোটি টাকার সেই ট্যাক্সের দরকার নেই। তার বিপরীতে তিনগুণ টাকা কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের লাভ হচ্ছে না। আমরা মনে করি, ধূমপান মুক্ত দেশ গঠন করতে পারলে আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। আর ধূমপান মুক্ত দেশ গঠন করতে পারলে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবো। বিশ্ব আমাদেরকে রোল মডেল হিসেবে ধরে ভাববে- জনবহুল দেশ হয়েও কিভাবে ধূমপান মুক্ত হয়েছে।
সময় জার্নাল : প্রকাশ্যে ধূমপান দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু অনেকেই তা মানছেন না। তাদের ব্যাপারে সরকার কি করতে পারে?
মো. শফিকুল ইসলাম : আমরা আশা করবো ধূমপানের যে আইন আছে তা যেন যথার্থভাবে প্রয়োগ করা হয়। আর মানুষ যাতে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে না পারে সে জন্য রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে স্মোক জোন তৈরী করে দেয়া হয়। যাতে মানুষ জানতে পারে এখান ছাড়া অন্য কোথাও ধূমপান করা যাবে না। করলে সেটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
সময় জার্নাল : ধূমপান মুক্ত দেশ গড়তে আমাদের করণীয় কি?
মো. শফিকুল ইসলাম : আমি যদি নিজে ধূমপান করি তাহলে আমার ছেলেকে তো বলতে পারবো না- বাবা তুমি ধুমপান করো না। সে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করবে কেন করবো না? আমি কি উত্তর দিবো। এজন্য আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। এটা করতে পারলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধূমপান মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ উপহার দিতে পারবো।
সময় জার্নাল : ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. শফিকুল ইসলাম : সময় জার্নালের পাঠদেরও ধন্যবাদ।
সময় জার্নাল/এসএ