বুধবার, ডিসেম্বর ১৮, ২০২৪
- ভিনদেশ থেকে আসছে উড়ে//হাওয়ার তালে হেলেদুলে//নানা রঙের পাখি ///নামছে ওরা হাওড়–বিলে//গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে//করছে ডাকাডাকি।
হেমন্তের শুরুতেই হাজার হাজার মাইল দূর থেকে একটু উষ্ণতার জন্য ছুটে আসা এসব পাখির কলকাকলি শুনে ঘুম ভাঙে হাওরবাসীর। শুধু হাওরাঞ্চল কেন, ইট-কংক্রিটের জঞ্জাল রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও এখন মুখরিত অতিথি পাখির কোলাহলে।
ছয়টি ঋতু তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। শীতে পিঠা পুলি , খেজুর রস এসবের পাশাপাশি আরেকটি বৈশিষ্ট্য বেশ লক্ষণীয়। অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখির আগমন। বিশেষ এক শ্রেণীর পাখি বিশেষ একটি সময় অতিথি হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বেড়িয়ে থাকে। তাদেরই আমরা সরল উক্তিতে অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি বলে থাকি।
প্রতিবছর শীত শুরু হলেই পৃথিবীর নানা দেশ থেকে অতিথি পাখি আমাদের দেশে পাড়ি জমায় একটু গা গরম করা উষ্ণতার জন্য। যুগের পর যুগ এলেও এখন অতিথি পাখিদের অভয়াশ্রমগুলোতে তেমন কলকাকলি শোনা যায় না। মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নানা কারণে দিন দিন বাংলার সৌন্দর্যশৈলীর একটি বিশেষ উপাদান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
শান্তির নীড় পেতে অন্তত একটা মৌসুম নিশ্চিন্ত থাকতেই পৃথিবীর শীতলতম প্রান্ত থেকে এ দেশে পাড়ি জমায় অতিথি পাখিরা।
এক জরিপে জানা যায় শুধু ইউরোপ আর এশিয়ায় আছে পাখিদের প্রায় ৬০০ প্রজাতি। যারা উত্তর মেরু থেকে ২২ হাজার মাইল পথ উড়ে দক্ষিণ মেরুর দেশগুলোতে বেড়াতে আসে। তবে আমাদের দেশের অতিথি পাখিরা এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার আংশিক পূরণ করে থাকে। তাদের ঠিকানা হলো বরফাচ্ছাদিত হিমালয় আর তিব্বত অঞ্চল। প্রচণ্ড হিমবাহ আর খাদ্যসঙ্কটে যখন পাখিদের প্রাণরক্ষায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখন তাদের বাঁচার তাগিদেই দেশান্তরি হতে হয়।
প্রতি বছরের মতো এবারো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করেছে বাহারি প্রজাতির অতিথি পাখি। সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া ও নেপাল থেকে আগত এসব অতিথি পাখি ক্যাম্পাসের লাল শাপলায় পূর্ণ লেকের পানিতে জলকেলিতে মেতে উঠেছে। আকাশও দখলে তাদের, ডানা মেলে উড়ছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। হেমন্তের শুরুতে হালকা শীতে ক্যাম্পাসে এসব পরিযায়ী পাখির আসা শুরু হয়। মাঘের শেষ পর্যন্ত থাকে তাদের এই পদচারণা। ক্যাম্পাসের গাছপালায় ঢাকা সবুজ প্রকৃতি আর পাখির খাদ্য ও বসবাস উপযোগী জলাশয়গুলোও যেন বরণ করে নেয় অতিথি পাখিদের। তাই শীতকালে এই জলাশয়গুলোকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরের পেছনের লেক, পুরনো প্রশাসনিক ভবনের সামনের লেক, সুইমিং পুলসংলগ্ন জয়পাড়া লেক ও ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারের সঙ্গে জলাশয়গুলোতে অতিথি পাখিরা ভিড় জমায়। ২০১৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
আর বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল, কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এই শীতেও কোলাহল মুখর পরিযায়ী পাখির কলরবে। হাওরের মাঝখানে স্বচ্ছ পানিতে দেখা যাবে অতিথি পাখির ওড়াওড়ি। কচুরিপানার মধ্যে ও পানিতে কিচিরমিচির শব্দে খেলা করছে হাজারো পরিযায়ী পাখি। চারদিকে কচুরিপানা, মাঝখানে পানিতে চুপটি বসে আছে পরিযায়ী পাখির দল। বিলের ওপর উড়ছে পাখির ঝাঁক। হাওরের আকাশজুড়ে উড়ছে শীতের পাখিরা। নীল আকাশে উড়ছে পরিযায়ী পাখিরা- মুহূর্তেই মন ভালো করে দেবে।
এসব পরিযায়ী পাখি দিনের আলোতে হাওরের জলে ভেসে বেড়ালেও রাতে আশ্রয় নেয় হিজলসহ বিভিন্ন বাড়ির গাছপালায়। তবে সব বাড়ির গাছে এরা আশ্রয় নেয় না। এরাও বোঝে নিরাপদ আশ্রয়। পাখি বিশারদদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। এদের প্রায় পাঁচ ভাগ হলো পরিযায়ী পাখি। ইংরেজিতে যাদের বলা হয় ‘মাইগ্রেটরি বার্ডস’। শীতপ্রধান দেশের এসব পাখি শীতকালে তাদের নিজ বাসভূমি ছেড়ে উড়ে চলে যায় হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে নাতিশীতোষ্ণ কোনো অঞ্চলে। যেখানে শীতকালটা তারা কাটিয়ে দেয়। তারপর শীতের শেষে আবার উড়ে যায় নিজের দেশে। এভাবে বছরের পর বছর পরিযায়ী পাখিরা উড়ে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ চেনে উড়ে বেড়াতে তাদের কোনোই অসুবিধা হয় না। অনেক পাখি আছে, যারা তাদের যাত্রাপথে হিমালয় পর্বতের সুউচ্চ শৃঙ্গ অতিক্রম করে। আবার অনেক পাখি অনন্ত গ্রীষ্মের খোঁজে উড়ে বেড়ায় উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর মাঝে। এসব পরিযায়ী পাখিকে দ্বিমুখী যাত্রায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম হয়।
পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে পাখিদের নিবিড় সম্পর্ক। সঙ্গত কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাসও তারা পেয়ে থাকে আগেভাগেই। তাই নিজ দেশে শীতের দাপট বাড়তে শুরু করলেই তারা ধীরে ধীরে সরে আসে উষ্ণমণ্ডলীয় দক্ষিণাঞ্চলে। বাংলাদেশে এ দৃশ্যপট প্রায় অর্ধশত বছরের।
তানহা আজমী