মো: মিরাজুল ইসলাম, খুবি প্রতিনিধি :
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ও পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিনের '১৭ব্যাচের দুই শিক্ষার্থী নূর মোহাম্মদ অনিক ও মো. মোজাহিদুল ইসলাম রাফিকে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। আওয়ামী সরকারের সাজানো জঙ্গি নাটকের বলি এই দুই শিক্ষার্থীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে (২৩ ফেব্রয়ারী) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদী প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিফিং- এ স্বজনরা বলেন, মিথ্যা মামলার শুনানি নেই প্রায় দুই বছর।
প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, অনিক ৩১২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র। কেমিস্ট্রি'১৪ ব্যাচের ইহসান নেওয়াজ ভাই তার রুমমেট। ৮ জানুয়ারি, ২০২০ সালের সকালে হলের অফিস ক্লার্ক এনামুল তাকে ডেকে তোলে, এই বলে যে, হল প্রভোস্ট শামীম স্যার ওর সাথে হলের লাইব্রেরী সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান। বাইরে যেয়ে দেখে, শামীম স্যার হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখেই ডাক দিলেন, "নূর, তোমার সাথে কথ্য আছে"। হলের লাইব্রেরীতে নিয়ে তোমার পরামর্শ চাচ্ছিলাম। স্যার গল্প করতে করতে হলের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত গল্লামারি থেকে মোহাম্মদ নগর যাওয়ার রাস্তার মোড়ে থাকা সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারিতে নিয়ে যান নাস্তা করাতে। সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারির সামনে পার্ক করা একটা কালো মাইক্রোর কাছে নিয়ে সাদা পোশাক পরা ডিবি পুলিশের হাতে তুলে দেন। পরে ওই কালো মাইক্রোবাসে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে এবং বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করে। ওকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, অনিক ফেসবুকে সরকারবিরোধী পোস্ট দিত কেন, সে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত?
সে যখনই বলতো, ও সাধারণ ছাত্র, রাষ্ট্রের কল্যাণার্থেই সমালোচনা করে। তারা ততবারই তাকে চরম নির্যাতন করে, ওর পেটের ভিতরে পিস্তল ঠেসে রাখে, ওর মুখে ও গুপ্তাঙ্গে চরম আঘাত করে। ঐদিন রাতে, খুলনা পুলিশ লাইন্সে নিয়ে আসে। ওই সময় খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, সম্ভবত ডিআইজি হাজী সাহেব হিসেবে পরিচিত লুৎফর কবির। তিনি ওর সাথে দেখা করেন, বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন।
এরপর, ২০২০ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি তারিখে দেশের জাতীয় নানান পত্রিকার খবরের মাধ্যমে, ভুয়া দুটি ঘটনার অবতরণা করে, বিশেষ অভিযানে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্যাদি উদ্ধার সহ তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবেই স্বীকার করেছে যে, ২৩ সেপ্টেম্বর খানজাহান আলী থানা কৃষকলীগ কার্যালয় ও ৫ ডিসেম্বর আড়ংঘাটা থানার গাড়ি রাখার গ্যারেজে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই ঘটনায় খানজাহান আলী থানা এবং আড়ংঘাটা থানার মামলা দেওয়া হয়। পরে সোনাডাঙ্গা থানায় বিস্ফোরক আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আরও দুটি মামলা দায়ের করা হয়। একই সময়ে তাদের ময়মনসিংহের কোতয়ালী থানার একটি মামলায় তাদেরকে আসামি করা হয়।
মোজাহিদুল ইসলাম রাফির বাবা, জনাব রেজাউল করিম বলেন, রাফিকে ক্রসফায়ারের হুমকিও দেয়। ইলেকট্রিক শক দেয়া, ঝুলিয়ে রাখা থেকে শুরু করে এমন কোন অত্যাচার নাই যা করা হয়নি। অতঃপর তাকে কিছু কাগজে সই করতে বাধ্য করে। ওদের সারা জীবন ধরে গুম রাখবে, এই ভয়েই ওরা কাগজে সাক্ষর করে। অতঃপর ওদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে ১৭ দিনেই তাদের প্রকাশ্যে আনতে বাধ্য হয়। নয়তো এত স্বল্প সময়ে সচরাচর কেউ আলোর মুখ দেখেনা বলেও জানানো হয়। বিগত চার বছরে নানা সময়ে, জেল থেকে আমাদের সাথে অনিক যোগাযোগের চেষ্টা করেছে এবং জেনেছি, তার রায় হওয়ার পরে, টাকার বন্দোবস্ত চাওয়া হয়েছিল, যা ব্যবস্থা করলে মুক্তির একটা আশ্বাস্য দেয়া হয়েছিল। অন্যায় ভাবে ওদের ছাত্রত্ব স্থগিত করা হয়েছে। তৎকালীন প্রশাসন তাদেরকে কোন রকমের আইনি সহযোগিতা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
স্বৈরাচার সরকার পতনের পরে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে অনিক ও রাফি কারাগারের অভ্যন্তরে অনশন করেন। কিন্তু তাতেও প্রশাসনের টনক নড়েনি।
আজকের প্রেস ব্রিফিংয়ে শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এই অন্যায় আটক ও সাজানো নাটকের প্রত্যাখ্যান করছি। বিগতদিনে আওয়ামীলিগ সরকার শিক্ষিত তরুণদের কণ্ঠ রোধ করতে একের পর এক জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নিরীহদের ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে।শিক্ষার্থীরা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, মানবাধিকার সংগঠন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
ভুক্তভোগী পরিবাররা জানান, মিথ্যা মামলা টানতে টানতে আমরা বা আমাদের পরিবাররা এখন অসহায়। আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার। এবং নিঃস্বার্থ মুক্তি। বিগতদিনে আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গি নাটক নাটক করে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট করেছে। আমরা চাই এমন যেন আর কারো না হয়। আমরা আমাদের সন্তানদের আমাদের কাছে চাই পরিবারের কাছে চাই। বিগত প্রায় দুই বছর ধরে এই কেসের কোন শুনানি চলছে না। প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের অনুরোধ আমাদের সন্তানদের নিঃশর্ত মুক্তি দিবেন এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন বা কামনা করছি।
হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সৈয়দ আজহারুল ইসলাম বলেন, আমার শিক্ষার্থীরা খুব জীবমুখী ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় বর্ষ থেকেই তারা উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছিল। নিয়মিত ক্লাসে আসতে এবং পড়াশোনা করতো পাশাপাশি ভালো ছাত্রও ছিল। আমি তাদের ভিতর এমন কোন আচরণ পাইনি যে তারা জঙ্গি হতে পারে। বিগত দিনে আওয়ামী লীগ সরকার এমন অনেক তরুণের জীবন নষ্ট করেছে জঙ্গি নাটক সাজ আমি মনে করছি এটি তার একটি পরিকল্পিত রূপ। আমার ছাত্র বা সন্তানদের আমি নিঃশর্ত মুক্তি চাই।