ডক্টর শোয়েব সাঈদ: আমাদের অভিবাসী জীবনটা যেন স্থিতু হওয়ার সংগ্রাম আর জন্মভূমির পিছুটানের টানাপোড়েনের এক নিরবচ্ছিন্ন উপাখ্যান। গত ১৫ মাসের কোভিড পরিস্থিতি এই টানাপোড়েনের নতুন এক অধ্যায়; ভাল থাকুক বাংলাদেশ, ভাল থাকুক কানাডা এই প্রার্থনায় আমাদের যাপিত জীবন।
ভাল নেই বাংলাদেশ, মহাবিপদে। ভারতের নজিরবিহীন কোভিড সংক্রমণে গুজরাট, মহারাষ্ট্র হয়ে যখন পশ্চিম বঙ্গের দিকে ধেয়ে আসছিল ডেল্টা ঢেউ, শংকিত চিত্তে আমরা তখন মিডিয়াতে সীমান্ত বন্ধ সহ কঠোর বিধিনিষেধের জন্যে মূলত চিৎকারই করছিলাম। সরকার যে শুনেনি তা কিন্তু নয়, তবে বাস্তবায়নে শিথিলতা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কমিটমেন্টের অভাব আর জনগণের গা ছাড়া ভাব লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
রাজশাহীর আমের মোহ, নির্বাচনের নেশা, ভারত থেকে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে চোরাগোপ্তা আসাযাওয়া আর আমাদের স্বভাবজাত শৈথিল্যের ককটেলে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে অনেকটা ঘূর্ণিঝড়ের তিন নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেতের মত ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক শিথিলতায় আমাদেরকে এখন দেশব্যাপী ফেলে দিয়েছে ১০ নম্বর মহাবিপদের মুখে।
বিশ্বের বহু দেশে সেনাবাহিনী কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। সেনাবাহিনী নামানোর কথা বলার মধ্যে ঝুঁকি থাকে, অনেকেই নানা কারণে অপছন্দ করেন, রুষ্ট হন। তারপরেও অনেক টকশো আর কলামে বহুবার সেনাবাহিনী ব্যবহারের কথা বলেছি। সংকটকালে অবুঝ জনগোষ্ঠীকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝাতে জলপাই রঙের ভূমিকা আমাদের শক্তের ভক্ত, নরমের যম কালচারে তো বহুল প্রমাণিত।
আজও পত্রিকায় দেখলাম চারিদিকে লকডাউন, শাটডাউনের সাজসাজ রবে বাসে, বাস স্টেশনে উপচে পড়া মানুষজন। টেস্টের বিপরীতে গড়পড়তা সংক্রমণ ২২%, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কোন কোন জেলায় ৬০-৭০% হয়ে যাচ্ছে। উপচে পড়া রোগীতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, সামাল দেওয়া যাবে না। কঠোরভাবে সামাল দেবার এখনই সময়।
বাংলাদেশে একশন প্লান ব্যর্থ হবার পেছনে মূল কারণ সঠিক সময়ে সঠিক আর ত্বরিত সিদ্ধান্তে সিদ্ধান্তহীনতা। কোভিড সংকট আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। রাজনৈতিক বক্তব্যে আর প্রতিশ্রুতিতে জনতুষ্টির চাইতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটা জরুরী। সংক্রমণটা কোন জায়গায় কিভাবে আটকাতে হবে সঠিকভাবে না করতে পারলে মহাবিপদটা ঠেকানো যাবে না।
জনসমাগম বিশেষ করে যানবাহন সংশ্লিষ্ট জনসমাগম যে কোন মুল্যে আটকাতে হবে। কোন মানুষ ১০ মিনিটের বেশী জনসমাগমে আটকে থাকলে সংক্রমণ সম্ভাবনা প্রবলতর হয়ে উঠে। লকডাউন অপছন্দের হলেও ডেল্টা সংক্রমণের এই কঠিন পরিস্থিতিতে সর্বশক্তি দিয়ে ১৫ দিনের কার্যকরী লকডাউনটা মহাবিপদটা ঠেকানোর জন্যে অতি জরুরী প্রাথমিক পদক্ষেপ।
লকডাউনটা যদি কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য হয়, বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাব হয় তাহলে অর্থনীতি আর গরীবের জন্যে ক্ষতিকর এই লোক দেখানো লকডাউনের দরকার নেই।
ভ্যাকসিনে আমাদের অবস্থান অনেকটা “কোথাও কেউ নেই” এর মত। বিক্ষিপ্তভাবে ১০-২০ লাখ ভ্যাকসিন সংবাদ প্রকাশে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় আটকে গেছে আমাদের ভ্যাকসিন কার্যক্রম।
ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাস সহ নানা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের মুখে বৈশ্বিকভাবে প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভ্যাকসিনেশন বা টিকাদান। উন্নত দেশগুলো টিকাদানের অগ্রগতিতে এখন অনেকটাই ফুরফুরে মেজাজে।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে কোভিডের মোট সংক্রমণে ডাবল ডোজ ভ্যাকসিনেশনের পর সংক্রমণ সম্ভাবনা মাত্র ০.৫% অর্থাৎ নিরাপত্তা ৯৯.৫%। সিঙ্গেল ডোজে সংক্রমণ সম্ভাবনা ৪% অর্থাৎ নিরাপত্তা ৯৬%। ভ্যাকসিন রক্ষা করছে জীবন, অর্থনীতি এবং সেই সাথে সাহায্য করছে স্বাস্থ্যখাতকে চাপমুক্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে।
টিকাদানে কানাডার অগ্রগতি দেখার মত। ১২ বছরের উপরের জনসংখ্যায় ডাবল ডোজের আওতায় এসেছে ২৭%, সিঙ্গেল ডোজের আওতায় এসেছে ৭৭%। কানাডার সর্বত্র দ্রুতগতিতে কমে আসছে সংক্রমণ। কানাডার লক্ষ্য ছিল শীত আসার আগেই ডাবল ডোজে সমগ্র কানাডাকে আচ্ছাদিত করা, প্রেগম্যাটিক আমলাতন্ত্র, দক্ষ টেকনোক্রেট আর কমিটেড রাজনৈতিক নেতৃত্ব শীতের অনেক আগে এই সামারেই সেই লক্ষ্যটি অর্জনের পথে। ডেল্টার উৎপাত আগেভাগেই রোধ করতে গতিময় হচ্ছে টিকা কর্মসূচি।
এই অর্জনের প্রভাব পড়ছে সমাজে, সরকার নিয়মকানুন ক্রমশ শিথিল করে চলেছে, ডাবল ডোজ যারা নিয়েছেন তারা মাস্ক ছাড়াই পরিচিতজনদের ছোটখাট গেদারিং এ অংশ নিতে পারবে। তবে বড় জনসমাগমে যেতে হলে মাস্ক পরতে বলা হচ্ছে।
ভ্যারিয়েন্টদের মধ্যে ডেল্টা বৈশ্বিক কোভিড ব্যবস্থাপনাকে বেশ ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। পশ্চিমাদের ডাবল ডোজ টিকাদান ভ্যারিয়েন্ট সমস্যার একটি সমাধান দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রমের অভাবে স্বল্পমেয়াদী কঠোর কার্যকরী লকডাউন, সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া এই মুহূর্তে গত্যন্তর নেই।
লেখক: ডক্টর শোয়েব সাঈদ, লেখক ও অনুজীব বিজ্ঞানী।