বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

লামিনে ইয়ামাল: এখন জন্মভূমির তরুণদের অনুপ্রেরণা বার্সার ফুটবল তারকা

মঙ্গলবার, মে ২৭, ২০২৫
লামিনে ইয়ামাল: এখন জন্মভূমির তরুণদের অনুপ্রেরণা বার্সার ফুটবল তারকা

স্পোর্টস ডেস্ক:

বার্সেলোনার সঙ্গে কিশোর বিস্ময় লামিনে ইয়ামালের নতুন চুক্তি নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে ওঠার পর, স্পেনের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া ট্যাবলয়েড মার্কা-র প্রথম পাতায় বড় হরফে ছাপা হয়েছিল—'লামিনে ইয়া!' (লামিনে এখনই)।

এই প্রতিভাবান উইঙ্গার চলতি মৌসুমে বার্সাকে লা লিগা শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার চুক্তি নিয়ে যতই আকাশছোঁয়া অর্থের আলোচনা হোক না কেন, স্পেনের এই ফুটবল বিস্ময়ের শুরুটা ছিল একেবারে সাধারণ জীবনের গল্প।

ইয়ামাল বড় হয়েছেন মাতারো শহরের একটি দরিদ্র এলাকায়। বার্সেলোনা শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই শিল্পশহরটি কাতালুনিয়ার ঝলমলে আলো ও আধুনিকতার থেকে অনেক দূরে।

স্পেনের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার তথ্য বলছে, মাতারোর রোকাফোন্দা অঞ্চলের প্রায় ১১ হাজার বাসিন্দার অর্ধেকই 'দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে' রয়েছেন। অনেক বাসা জরাজীর্ণ, নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা।

এই এলাকায় ৮৮টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন। আরব 'হালাল' কসাইদের দেখা মেলে প্রায়শই। রোকাফোন্দার সড়কে খেলতে খেলতেই বেড়ে উঠেছেন ইয়ামাল।

এলাকার একটি কেন্দ্র স্কুলে পিছিয়ে পড়া শিশুদের সহায়তা করা হয়। এলাকাটির অন্যতম প্রধান সংকট হলো বাসাভাড়া—মাসিক গড় ভাড়া ১,৩৩৪ ডলার, যা বহু পরিবারের সাধ্যের বাইরে। উচ্ছেদ এখানে রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা

তবু, ফুটবল—বা বলা ভালো, ইয়ামাল—এই জায়গায় মানুষকে আশার আলো দেখায়।

মিউনিসিপাল ফুটবল মাঠ 'ক্লাব দে ফুটবল রোকাফোন্দা'র এক দেয়ালে লেখা আছে: 'রোকাফোন্দায় আরও অনেক লামিনে ইয়ামাল দরকার, উচ্ছেদ নয়।'

আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মোহাম্মদ কাদুরি, যিনি ইয়ামালের চেয়ে এক বছরের ছোট, বলেন—বার্সেলোনার এই খেলোয়াড়টি এখানকার তরুণদের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা।

তিনি বলেন, 'ইয়ামালের পর থেকে অনেকেই ফুটবল খেলতে শুরু করেছে। সবাই বিশ্বাস করছে, তার মতো হওয়া সম্ভব। শুধু ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও এখন ফুটবল খেলছে।'

তার বন্ধু দামিয়া কাস্তিয়ো (১৬) জামালের সঙ্গে দেখা করেছিল, যখন সে তার পরিবারকে দেখতে এলাকায় ফিরে এসেছিল।

কাস্তিয়ো বলেন, 'সে আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে, যেন সে একদম সাধারণ একজন মানুষ—বড় কোনো তারকা নয়। সে এখানকার, আমরাও এখানকার। তখন মনে হয়, হয়তো আমিও পারব।'

মেসি প্রভাব

বন্ধুরা বলেন, ইয়ামালের অবিশ্বাস্য প্রতিভার পেছনে রয়েছে রোকাফোন্দার রুক্ষ সড়কে খেলার কঠিন বাস্তবতা—একপ্রকার 'অগ্নিপরীক্ষা'র মধ্য দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ।

'লামিনে ছোটবেলা থেকেই বড় ছেলেদের সঙ্গে খেলত। অনেকে ছিল তার চেয়ে শক্তপোক্ত, অনেকে ছিল একেবারে দুঃসাহসী। তাই ওর খেলার গতি ও বুদ্ধিমত্তা ছোটবেলাতেই গড়ে উঠেছে,' বলেন পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোহাম্মদ বেন সেরঘিন।

তিনি আরও বলেন, 'এই খ্যাতির ভিড়েও ও বিনয়ীই রয়ে গেছে। যখনই রোকাফোন্দায় পরিবারের কাছে ফিরে আসে, ছোটদের সঙ্গে দারুণ মিশে যায়।'

স্থানীয় একটি বার 'বার এল কোরদোবা'-তে ইয়ামালের বাবা মুনির নাসরাউই মাঝেমধ্যে আসেন।

বারের দেয়ালে ঝুলছে ইয়ামালের সই করা, ছবি লাগানো বার্সেলোনার পুরোনো এক জার্সি, যা এখন কিছুটা হলদেটে হয়ে গেছে।

গত বছর স্পেন জাতীয় দলের এই উইঙ্গারের বাবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলের একটি পুরোনো ছবি প্রকাশ করেছিলেন। ছবিটি তখনকার, যখন ইয়ামাল ছিল কেবলই এক শিশু।

২০০৭ সালে ক্যাম্প ন্যুতে এক ফটো সেশনে ২০ বছর বয়সী লিওনেল মেসির কোলে ছয় মাসের শিশু লামিনে ইয়ামাল। ছবি: এপি
ছবিতে দেখা যায়, তাকে কোলে নিয়ে আছেন তৎকালীন বার্সেলোনা তারকা লিওনেল মেসি। ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল: 'দুই কিংবদন্তির শুরু—দুজনেরই পথচলার সূচনা।' এখন সেই ছবিটি যেন ভবিষ্যতের এক নিখুঁত পূর্বাভাস।

সেই সময় মেসির বয়স ছিল ২০। তিনি এফসি বার্সেলোনার পক্ষ থেকে ইউনিসেফের একটি প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। ইয়ামাল ছিল মাত্র পাঁচ মাসের, যখন তার বাবা-মা একটি র‍্যাফেল ড্র'তে তার নাম লেখান। আর ভাগ্যক্রমে তার সঙ্গ জুটেছিল মেসির সঙ্গে। ফটোশ্যুটে স্নেহময় হাসিতে ছোট ইয়ামালই মুগ্ধ করে ফেলেছিল তখনকার সময় কিছুটা সংকোচে থাকা মেসিকে।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৭ বছর বয়সে মেসির চেয়েও এগিয়ে ইয়ামাল—এমনটাই জানাচ্ছেন ইএসপিএনের ফুটবল লেখক রায়ান ও'হ্যানলন।

তিনি লিখেছেন, 'সামগ্রিকভাবে যে চিত্রটি ফুটে উঠছে তা হলো—[মাইকেল] ওয়েন, কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং ইয়ামাল আধুনিক ফুটবল ইতিহাসের সেরা কিশোর ফুটবলারদের মধ্যে পড়ে।' তার এই মন্তব্য গোল ও অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে।

বার্সেলোনার উপশহরের এক প্রান্তিক এলাকা রোকাফোন্দা—অন্য অনেক উপেক্ষিত পাড়ার মতো হয়তো একদিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেত, যদি না ইয়ামাল থাকতেন।

এলাকার দেয়ালে কেউ বড় করে লিখে রেখেছে '৩০৪'। প্রথম দেখায় দেয়ালচিত্র মনে হলেও, বিষয়টা তার চেয়েও গভীর। ইউরো ২০২৪-এ ফ্রান্সের বিপক্ষে অসাধারণ এক গোল করার পর উদ্‌যাপন করতে গিয়ে ইয়ামাল আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন তিন, শূন্য, চার—এই সংকেত। সেটিই রোকাফোন্দার পোস্টকোড, পুরোটা লেখা হলে হয় ০৮৩০৪।

যখন গোটা বিশ্ব ইয়ামালের চোখ ধাঁধানো ফুটবল নৈপুণ্যে মুগ্ধ, তখন তার এই ইশারা ছিল এক নিঃশব্দ বার্তা—কোটিপতি খেলোয়াড় হয়েও কেউ কেউ নিজের শিকড় ভুলে যায় না।

খেলোয়াড়ের চাচা আব্দুলের পরিচালিত 'বার ফ্যামিলিয়া এল ওয়াই ৩০৪ রোকাফোন্দা'য় ঢুকলেই বোঝা যায়, ইয়ামাল এখনও তার নিজের জায়গা, নিজের মানুষদের প্রতি কতটা অনুগত।

দেয়ালে টাঙানো ইয়ামালের ছবি আর স্বাক্ষর করা জার্সিতে ভরা পুরো ক্যাফে। এক কোণে রাখা প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা বিশ্বকাপ ট্রফি যেন কল্পনার খোরাক জোগায়—একদিন কি সত্যিই ইয়ামাল স্পেনের হয়ে আসল ট্রফিটা তুলবেন?

তিন দশক আগে ইয়ামালের নিজের গল্প শুরু হয়েছিল, যখন তার নানি ফাতিমা মরক্কো থেকে স্পেনে এসে এক বৃদ্ধাশ্রমে কাজ নেন।

একজন সিঙ্গেল মাদার-এর মতোই তিনি পরিশ্রম করে নিজের সাত সন্তানকে মরক্কো থেকে স্পেনে আনেন।

ইয়ামালের মা শিলা এবানা পশ্চিম আফ্রিকার সাবেক স্প্যানিশ উপনিবেশ ইকুয়েটোরিয়াল গিনির নাগরিক। ইয়ামালের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। এরপর শিলা যখন রোকাফোন্দা ছেড়ে চলে আসেন, তখন তিনি ছেলেকে কাছের শহর গ্রানোইয়ের্সের 'ক্লাব দে ফুটবল লা তোরেতা'তে ভর্তি করান।

ইয়ামাল ভালোবাসা নিয়ে বলেন তার মায়ের কথা, যিনি যতটুকু সম্ভব সুন্দর শৈশব উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নানা প্রতিকূলতার মাঝেও।

একটি ইনস্টাগ্রাম সাক্ষাৎকারে ইয়ামাল বলেন, 'হয়তো আমার শৈশবটা সবচেয়ে ভালো ছিল না, কিন্তু আমি তা বুঝিনি। আমি শুধু সুন্দর দিকটাই দেখেছি—তার (মা) জন্যই।'

তাদের ছেলে এখন এক মহাতারকা হয়ে ওঠায়, দু'জনের জীবনেই এসেছে বড় পরিবর্তন।

এবানা এখন ইনস্টাগ্রামে অনুসরণকারী পেয়েছেন ২ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি এবং তিনি এখন বার্সেলোনায় বাস করছেন। ইয়ামালের বাবা-ও চলে এসেছেন কাতালান এই রাজধানী শহরে।


সিএফ লা টোরেটা ক্লাবের জানালায় দুটি ছবি রয়েছে—একটি ইয়ামালের ছোটোবেলার, আরেকটি সাম্প্রতিক সময়ের। ছবি: আল জাজিরা
বদলে যাওয়া প্রত্যাশা

ইয়ামাল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে খেলতে শুরু করেন সিএফ লা টোরেটায়। ছোট এই ক্লাবে মাত্র ২০০ জন খেলোয়াড় আছে।

ক্লাবের জানালায় দুটি ছবি রয়েছে—একটি ইয়ামালের ছোটোবেলার, আরেকটি সাম্প্রতিক সময়ের।

'সে পাঁচ বছর বয়সে এখানে আসে এবং মাত্র দুই বছর থাকে, তারপর বার্সেলোনা তাকে নিয়ে যায়,' বলেন সিএফ লা টোরেটার সভাপতি জর্দি ভিজকাইনে।

তিনি বলেন, 'আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না ইয়ামাল কতদূর এগিয়েছে, যখন দেখি সে বার্সা ও স্পেনের হয়ে খেলছে। সে এখানে আসার সময় ছোট একটি ছেলে ছিল, আর আজও আসলে সে এক শিশু।'

রোকাফোন্দা প্রতিবেশী সমিতির সভাপতি রোজিও এসকান্দেল ইয়ামাল ও তার পরিবারের সঙ্গে সারাজীবন পরিচিত।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, 'লামিনে রোকাফোন্দাকে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে এনেছে। এটা একটা শ্রমজীবী এলাকা যেখানে অনেক অভিবাসী আছে। কিন্তু সে এখানে সবাইকে বিশ্বাস করিয়েছে, তারা কিছু হতে পারে। ফুটবলার হওয়াই প্রয়োজন নেই, ডাক্তারও হতে পারে। শুধু বিশ্বাস করতে হবে।'

তার নয় বছর বয়সী কন্যা অ্যাব্রিল লামিনে ইয়ামালের বদলে দেওয়া প্রত্যাশার একটি জীবন্ত প্রমাণ।

অ্যাব্রিল বলে, 'আমি ছোট থেকেই ফুটবল খেলছি, আর প্রতিদিন আরও গোল করি। বড় হলে আমি লামিনে-র মতো হতে চাই।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল