নিজস্ব প্রতিবেদক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সুযোগ এসেছে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সকল মানুষ জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বৈষম্যহীন দেশ গড়া, দেশকে এগিয়ে নেয়ার।
সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ শুরু করলেও নানামুখী চাপে অনেক উদ্যোগই আশানুরূপ আগায়নি। বেকারত্ব, লিঙ্গ বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ততা, শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করা এবং জনস্বার্থে সম্পদ পুনঃবণ্টনের মাধ্যমে গভীর সমস্যা মোকাবেলার জন্য একটি সুস্পষ্ট কর্ম পরিকল্পনা করে আগালে এক অদম্য বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
আর এই দেশ গড়তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছেন জিওপলিটিক্যাল ইকোনমিস্ট অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ। 'বাংলাদেশে একটি জনবান্ধব সমাজ ও অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা' বইতে অধ্যাপক পারভেজ তথ্য নির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
আজকের লেখায় অধ্যাপক পারভেজের রুপরেখার প্রথম পর্ব-
যুবক ও নারীদের কর্মসংস্থানে ক্ষমতায়ন
বাংলাদেশ বর্তমানে উচ্চ যুব বেকারত্ব এবং কম নারী শ্রম শক্তি অংশ গ্রহণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সর্বশেষ শ্রম শক্তি জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ১৯.৪ লাখ যুবক (১৫-২৯ বছর বয়সীদেরও ৭.২%) বেকার
(১) জাতীয় বেকারত্বেও হার প্রায় ৩.৫%, কিন্তু যুবাদেরও ক্ষেত্রে তা দ্বিগুণেরও বেশি (৮%)
(২) এদিকে, নারী শ্রম শক্তি অংশগ্রহণ মাত্র -৩৭% (২০২৩), যেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ প্রায়-৮০%
(৩) আরও উদ্বেগজনক হলো, ১৫-২৪বছর বয়সী তরুণী মেয়েদেও মধ্যে ৬২% (শিক্ষা, কর্মসংস্থান অথবা প্রশিক্ষণের বাইরে) অবস্থায় আছে
(৪) এই পরিসংখ্যানগুলিই প্রমাণ করে কেন যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান এবং নারীদেও কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো জরুরি। দক্ষতা প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ, নারীদের জন্য কর্মসংস্থান প্রণোদনা এবং উদ্যোক্তা সহায়তা বৃদ্ধি করে এই নীতিমালা তরুণ এবং নারীদের উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করতে চায়, যা সরাসরি বিদ্যমান ঘাটতিগুলো মোকাবেলা করবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি
যদিও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় $২,৭৮৪ -এ পৌঁছেছে
(৫) কিন্তু এই সমৃদ্ধি সবার মধ্যে সমানভাবে বিতরণ হয়নি। জাতীয় গড়ে মাসিক পারিবারিক আয় ৩২,৪২২টাকা হলেও, গ্রামে তা মাত্র ২৬,১৬৩টাকা, আর শহরে ৪৫,৭৫৭টাকা
(৬) এতে গ্রাম-শহর আয়ের বৈষম্য স্পষ্ট। ২০২২ সালের তথ্যে দেখা যায়, এখনো ১৮.৭% জনগণ দারিদ্রের মধ্যে বাস করে গ্রামে ২০.৫% এবং শহরে ১৪.৭%
(৭) বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের দারিদ্রের হার সর্বোচ্চ- (২৬.৯%)
(৮) এই বৈষম্যই নীতিমালার "অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি"র অগ্রাধিকারে যুক্তি দেয়। গ্রামীণ উন্নয়ন, জীবিকা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কে বিনিয়োগ করে প্রস্তাবিত নীতিমালা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করে। বিশেষ করে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও গ্রামাঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করলে বর্তমান আয়ের বৈষম্য কমবে এবং প্রবৃদ্ধি আরও ন্যায্য হবে।
স্বাস্থ্য সেবার প্রবেশ গম্যতা উন্নয়ন (গ্রাম-শহর ভারসাম্য) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত অসম
দেশের ৬৬%-এর বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া এখনও বড় চ্যালেঞ্জ
(৯) গ্রামাঞ্চলে হাসপাতালও চিকিৎসকের ঘাটতির কারণে স্বাস্থ্যগত ফলাফল খারাপ হচ্ছে। যেমন, গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৪২.৮% মায়ের চারটি প্রসব পূর্ব সেবা নেওয়া হয়, যেখানে শহরে তা ৫৯%
(১০) গ্রামে মাত্র ৪৫% জন্ম স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হয়, শহরে তা ৬৩%
(১১) বাংলাদেশে প্রতি ১,০০০জনে মাত্র- ০.৬৭জন চিকিৎসক রয়েছে, এবং তাদের বেশিরভাগ শহরে কেন্দ্রীভূত
(১২) নার্সের সংখ্যা আরও কম, প্রতি ১,০০০জনে মাত্র ০.৬১জন
(১৩) হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে (ইঐঋঝ) ২০২২ অনুযায়ী, দেশে মোট ১৩,৯০৭টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে, যার মধ্যে শহরে ২৪.৩% এবং গ্রামে ৭৫.৭%
(১৪)। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান (৭১.৬%), কিন্তু শহরে ব্যক্তিগত হাসপাতালের সংখ্যা অনেক বেশি (৪৫.৬% বনাম গ্রামে ১৯.৭%)।
এই তথ্যগুলো স্বাস্থ্যসেবায় অবকাঠামো ও পরিষেবার প্রবেশ গম্যতায় নগর-গ্রাম বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। সুতরাং, গ্রামাঞ্চলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উন্নয়ন, গ্রামে চিকিৎসক ও ইন্টার্ন পাঠানো এবং গ্রামীণ পরীক্ষাগার আধুনিকায়ন এই নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ। এগুলো বাস্তবায়ন করলে স্বাস্থ্যসেবার ন্যায্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হবে, যেমনটি এই রূপরেখায় কল্পনা করা হয়েছে।
এমআই