মো. মাইদুল ইসলাম:
যুগ যুগ ধরে বজ্রপাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়ে আসছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যা প্রতি বছর বেড়েই চলছে। এ বছর একদিনেই মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। কিন্তু বজ্রপাত নিরোধ ও প্রাণহানি কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিভিন্ন সময়ে প্রতিরোধে যে-সকল প্রযুক্তি বসানো হয়েছে তা ডিজিটাল ছিল না, ফলে সে যন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি বজ্রপাত ঠেকিয়ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি নিরোধের প্রমাণ মিলেছে নতুন ইন্টারনেট অফ থিংকস (আইওটি) বেইজড ডিজিটাল ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল (ইএসইএটি)’ প্রযুক্তিতে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বজ্রপাত ঠেকিয়ে ভূগর্ভে পাঠানো ও বজ্রপাতের সংখ্যা রেকর্ড করেছে এই নতুন প্রযুক্তি। আইওটি সংবলিত হওয়ায় বজ্রপাতের রেকর্ড সময়, তারিখ ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে ঘরে বসেই। দেশে স্থাপিত যন্ত্রগুলোর কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ায় এ যন্ত্র আরও বেশি বসানোর দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।
‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ যন্ত্রটি চারপাশে ৯৭ মিটার এলাকা পর্যন্ত বজ্রপাত প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। এই যন্ত্র ইন্সটলেশনে খরচ হয় ১০ লক্ষ টাকা। একবার ইন্সটলেশন করা হলে পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারকে আর কোন খরচ বহন করতে হবেনা। পরীক্ষামূলকভাবে বসানো এই যন্ত্র থেকে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে, চলতি বছরের ৯ অক্টোবর সেখানে সংঘটিত একটি বজ্রপাত ঠেকিয়েছে যন্ত্রটি। অন্যদিকে নেত্রকোনার পূর্বধলায় স্থাপিত ইএসইএটি ৫ সেপ্টেম্বর আরেকটি বজ্রপাত ঠেকিয়েছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের স্থাপিত একটি যন্ত্র বজ্রপাত প্রতিরোধ করার রেকর্ড দিয়েছে।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের গাজীপুর ও গোবরখোলা গ্রামের সংযোগ স্থানে বসানো হয়েছে একটি আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ (ইএসইএটি)। সেখানে গিয়ে দেখা যায় পাশেই মো. সোহেল ও মো. নুরুল হক নামের দুই কৃষক ধান কাটছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই যন্ত্র স্থাপনের পরে তার আশেপাশের মানুষ বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তারা নির্বিঘ্নে কৃষি কাজ করতে পারছে। তারা মাঠে আরও বেশি এই যন্ত্র স্থাপনের জন্য বলেন। এ বিষয়ে জানতে চুনারুঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কর্মকর্তা নুর মামুনের কাছে গেলে, তার কাছেও মোবাইলে আইওটির মাধ্যমে পাওয়া রেকর্ড থেকে এই যন্ত্রের বজ্রপাত প্রতিরোধের প্রমাণ মিলেছে।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও মাবধপুরের সাবেক সংদস্য ও বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শাম্মি আক্তার বলেন, দেশের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হওয়া ৫ জেলার মধ্যে হবিগঞ্জ অন্যতম। গত ১৭ মে রাতেও বজ্রপাতে একজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের উপজেলায় দুটি বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এই দুটি দিয়ে অল্পকিছু এলাকা নিরাপদ থাকবে। কিন্তু আমাদের এখানকার কৃষকরা বর্ষা মৌসুমে মাঠে কাজ করে। তাদের ঘরে থাকার সুযোগ কম। তাই আরো বেশি করে যন্ত্রটি স্থাপন করা দরকার। কেননা এ পর্যন্ত যতগুলো প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে বজ্রপাত নিরোধনে সেখানে এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করছে।
তিনি বলেন, বজ্রপাতে আরেকটি প্রাণও যেন না ঝরে সেজন্য এসব এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত ডিভাইস স্থাপন করা দরকার। কেননা এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষক কাজ করে সেখানে কোন ধরনের শেল্টার থাকে না বা সুযোগও নেই। আর এসব যন্ত্র যেহেতু প্রায় আধা কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে কাজ করে তাহলে অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
সম্প্রতি দেশের ২১ জেলায় ২৫০ টি বজ্র প্রতিরোধ যন্ত্র স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ৮০ টি আইওটি সুবিধা সংবলিত বাকি ১৭০টি টি এনালগ যন্ত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আইওটি সংবলিত যন্ত্রগুলোতে বজ্রপাত নিরোধের রেকর্ড পাওয়া গেছে। যে এলাকায় বসানো হয়েছে সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারাও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে মত দিয়েছেন। অপরদিকে এনালগ যন্ত্রগুলোর কোনো রেকর্ড না থাকায় সেগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে ধোঁয়াশা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ যন্ত্রগুলো বসানোর উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০০টি ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ (ইএসইএটি) বসানো হয়েছিলো। তারপর সেখানে আর কোন বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেনি।
বজ্রপাতে দেশে প্রতিবছর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, যার বেশিরভাগই কৃষক। গত বছর মৃত্যুর সংখ্যা ২৯৭ জন আর এ বছর ২৮ এপ্রিল একদিনেই মারা গেছে ২৩ জন। এছাড়াও বৃষ্টি হলেই কোথাও না কোথাও মানুষ বা পশু মৃত্যুর সংবাদ আসছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষজন। সরকার বজ্রপাতকে ২০১৬ সাল থেকে একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে ঘোষণা করেছে, তবু বজ্রপাতের ফলে হতাহতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত গৃহীত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও গাইবান্ধা দেশের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা। হাওর অঞ্চলগুলোতে তুলনামূলক বেশি বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষত কৃষক ও জেলেরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বজ্রপাতে ১৭৭ জনের মধ্যে ১২২ জনই কৃষক। বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা এখন অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সাইক্লোন, বন্যা ও ভূমিধসে নিহতের সংখ্যার চেয়ে বেশি।
পরীক্ষামূলকভাবে এখন পর্যন্ত পাবনা, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা, শরীয়তপুর, ফেনী, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, জামালপুর, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া ও লালমানিরহাটের কিছু কিছু উপজেলায় বজ নিরোধক এ যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে চুনারুঘাটের গাজীপুর গ্রামের কলেজ শিক্ষার্থী জুবায়ের তালুকদার বলেন, এই এলাকায় গত কয়েকবছরে প্রচুর বজ্রপাত হচ্ছে। আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল’ (ইএসইএটি) বসানোর পর এর আশেপাশে বজ্রপাতের প্রভাব পড়েনি। বর্তমানে বজ্রপাত কিছুটা কমেছে।
আরও বেশি ইএসইএটি যন্ত্র স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, গ্রামগুলোতে মাঠে, নদীর পাশে এই যন্ত্র বসালে উপকৃত হবে মানুষ।
আইওটি সংবলিত এই যন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে চুনারুঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কর্মকর্তা নুর মামুন বলেন, এর কাজই বজ্রপাত প্রতিরোধ করে ভূপতিত করা। আমরা অফিসে বসে মোবাইলে এর কার্যকারিতা আছে তা দেখতে পারবো, রিডিং দেখতে পাবো। অ্যাক্টিভ আছে কিনা দেখতে পারবো। যেহেতু আমরা রিডিং পাচ্ছি তাই আমি মনে করি এটা সফল।
তিনি বলেন, আমাদের মিনিস্ট্রিতে প্রথম এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। আমরা এ পর্যন্ত এই ডিভাইস থেকে বজ্রপাত প্রতিরোধেরে রিডিং পেয়েছি। আসলে বজ্রপাত যে এই এরিয়ায়ই হবে তেমনও তো না, তবে এর মধ্যে হলে আমরা জনগণকে উপকৃত করতে পারবো। আশা করি আমরা যদি আরও এটির বিস্তৃতি লাভ করতে পারি বিশেষ করে যে-সব এলাকায় আমাদের কৃষক বা লোকজন বেশি সমাগম হয় সেখানে এটি বসাতে পারলে আরও বেশি উপকৃত হবে। যেহেতু বজ্রপাতপ্রবণ দেশ এবং এটা বাড়তেছে তাই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি যাতে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যায় এবং মানুষের উপকার হয়।
এ বিষয়ে আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বিজনেস হেড শেখ হাসিনা আক্তার বলেন, যে কয়টা লাইটিং আইওটি বেইজড ডিভাইন স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো কতগুলো বজ্রপাত প্রতিরোধ করেছে। কত তারিখে, কোন সময়, তখন সেই স্থানের তাপমাত্রা কেমন ছিল, যন্ত্রের ব্যাটারি স্ট্যাটাস ইত্যাদি সহ সেটার কাউন্ট জরুরি সেবাদান কেন্দ্রের রেকর্ডে দেখা যায়। এছাড়াও প্রতিটি উপজেলা কেন্দ্রের পিআইওকে তার ই-মেইল দিয়ে এক্সেস দেয়া, তারা দেখতে পারবে এখানে কোন লাইটিং হয়েছে কিনা। লাইটিং হলে তাদের কাছে অটোমেটিক ই-মেইল চলে যাবে। আবার ডিভাইসটা ইনঅ্যাক্টিভ হলেও ই-মেইল নোটিফিকেশন পাবে। আইওটি বেইজড হওয়ায় সহজেই বোঝা যায় ডিভাইসটা অ্যাক্টিভ আছে কিনা। এছাড়াও এর ডাটাগুলো সংরক্ষিত থাকে। এর ফলে কয়েকবছর পরেও শনাক্ত করা সম্ভব হবে দেশের কোন জেলায় বেশি বজ্রপাত হয়। কোন জেলাগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে।
আইওটি বেইজড প্রযুক্তি সার্বক্ষণিক অনলাইন মনিটরিং সুবিধার মাধ্যমে বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থাপনার টেকসই উন্নয়ন ও প্রযুক্তির যুগপৎ ব্যবহার নিশ্চিত করছে। আইওটি ছাড়া ডিভাইসগুলোতে এই সুযোগগুলো থাকেনা। আইওটি যন্ত্রের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাবেন দেশবাসী।
এমআই