মোঃ এমদাদ উল্যাহ:
আনোয়ার হোসেন। বয়স নয় বছর। কাজ করছে একটি হোটেলের পানি বয় হিসেবে। এ বয়সে তাঁর শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুল- মাদরাসায় থাকার কথা থাকলেও দারিদ্র্যতা তাকে নিয়েছে হোটেলে! আবার জীবিত নেই তার বাবা আলতাফ হোসেন। মা অংকুরের নেছা কাজ করেন অন্যের বাসায়। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায় হলেও জীবিকার তাগিদে এসেছে চৌদ্দগ্রাম বাজার এলাকায় চান্দিশকরা গ্রামে। এখানে টিনসেডের ভাড়া বাসায় থেকে অংকুরের নেছা ও তার ছেলে আনোয়ার হোসেনের জীবন চলছে কোনরকম।
সিফাত মিয়া। বয়স বারো বছর। মিয়াবাজার এলাকার একটি গ্যারেজে গাড়ি ‘মেরামত’ কাজ করছে। তাঁর মা জীবিত নেই। বাবা মোসলেম মিয়া অন্য নারীকে বিয়ে করেছেন। সৎ মা জোহরা খাতুন তাঁর যত্ন নেয় না। গ্যারেজে কাজ করে মাসে তিন হাজার টাকা বেতন পায়। সেই টাকা আবার সৎ মাকেই দিয়ে দেয়।
আনোয়ার হোসেন ও সিফাত মিয়ার মতো লাখ লাখ শিশু দারিদ্র্যতার কারণে পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হয়ে কাজ করছে। ছোটখাটো কলকারখানা থেকে শুরু করে পাথর ভাঙা, ফেরি করা, ভিক্ষাবৃত্তি, বাসা-বাড়িতে কাজ, গার্মেন্টস্ধসঢ়;, গ্যারেজ, দোকানপাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু শৈশব মানে আনন্দ, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার দিগন্ত। সেই শৈশব যখন ভেঙে যায় ইটভাটা, কারখানা কিংবা ক্ষতিকর পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের বোঝায়, তখন এটি একটি জাতির জন্য শুধু লজ্জা নয়, ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে শিশুশ্রম একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সামাজিক অসচেতনতার চক্রে আটকা পড়া শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলে। লাখ লাখ শিশু তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটাচ্ছে কঠিন শ্রমে। গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে নির্মাণশিল্প, ইটভাটা, কৃষি কিংবা কারখানায় শিশুশ্রমিকের উপস্থিতি ক্রমে বেড়েই চলেছে। অভিভাবকদের দারিদ্র্য, শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শিশুদের শ্রমে ঠেলে দেয়।
জানা গেছে, শিশু হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। মেহেদিপাতার বুকে যেমন লাল রঙ লুকিয়ে থাকে, তেমনি শিশুদের হৃদয়ের মধ্যেও এক অযুত সম্ভাবনাময় জাতি লুকিয়ে আছে। কিন্তু যে শিশু কুঁড়ি অবস্থাতেই নেতিয়ে পড়ে, ঝরে যায়, ফুল হয়ে ফুটতে পারে না- তাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ কল্পনা করা নিতান্তই কঠিন ব্যাপার। এসব শিশু যদি এভাবে শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ত ও সচ্ছল সংসারে শিক্ষার আলো পেত, তা হলে অবশ্যই তারা ভবিষ্যতের হাল ধরতে পারত এবং জাতিও তাদের কাছ থেকে পেত প্রত্যাশার উজ্জ্বল ঠিকানা।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি সব বাংলাদেশি ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, করোনাকালীন শিশুশ্রম অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ যৌথভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের ৭০ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত আর বাকিদের মধ্যে ২০ শতাংশ সেবা খাতে এবং ১০ শতাংশ শিল্প খাতে নিয়োজিত রয়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে শিশুশ্রম দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। কম মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ দিতে পারায় কিছু স্বার্থান্বেষী কারখানা মালিক কম বয়সি কিশোরদের কম বেতনে কাজে নিয়োগ দেয়। বিভিন্ন সময় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।
শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। একটি দরিদ্র পরিবারে শিশুরা প্রায়ই বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অভিভাবকেরা তাদের স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে কাজে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে শিশুশ্রম বন্ধে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজ করা নিষিদ্ধ। তবে এসব আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতা, পর্যাপ্ত তদারকির অভাব
এবং সামাজিক সচেতনতার ঘাটতি আইনগুলোর কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক সময় শিশুশ্রমের শিকার পরিবারগুলোও সরকারের সহায়তা প্রকল্পের বাইরে থাকে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তৈরি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো সব সময় তাদের কাছে পৌঁছায় না। তাছাড়া দ্রæত নগরায়ণ এবং গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন শিশুশ্রমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজের প্রতিটি অংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পরিবার, স্কুল, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। শিশুশ্রমমুক্ত একটি সমাজ গড়ার অর্থ হলো একটি জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ, নিরাপদ শৈশব ও স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা যদি সবাই মিলে কাজ করি, তাহলে একদিন শিশুশ্রম একটি অতীতের অধ্যায় হয়ে উঠবে। সেই দিনের প্রত্যাশায় আমাদের আজকের উদ্যোগগুলোকে
আরও শক্তিশালী করতে হবে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই শ্রম শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শিশুশ্রম বন্ধের কথা বারবার ঘোষিত হলেও এই করুণ বাস্তবতার কার্যত কোনো প্রতিরোধ নেই। দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই মহতি উদ্যোগে এগিয়ে যেতে হবে।
শিশুদের এই অমানুষিক শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে প্রধানত যেসব কারণ শনাক্ত করা যেতে পারে- তা হচ্ছে অভাব, দারিদ্র্য, মিথ্যা প্রলোভন, ভবঘুরে থাকা ইত্যাদি। অন্যদিকে জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি ও শিক্ষার অভাবও শিশুদের শ্রম বিক্রিতে সহায়তা করে থাকে। দেশের আনাচে-কানাচে শিশুশ্রমের করুণচিত্র সহজেই চোখে পড়ে।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভ্রাম্যমাণ শিশুদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ লেখাপড়া করে। তাদের পরিবার থেকেও শিক্ষার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ প্রদান করা হয় না বা প্রয়োজনবোধ করে না। তাদের মতে-উপার্জন করানোই যেখানে মুখ্য, সেখানে লেখাপড়া শেখানোর দরকার নেই।
বিভিন্ন শ্রমে নিযুক্ত থাকার কারণে শিশুদের সারাদিন কিংবা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। তারা কখনো সামাজিক বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতে পারে না। ফলে তাদের মনে সৃষ্টি হয় এক গভীর হতাশাবোধ। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রকট হওয়ার কারণে শিশু-কিশোরদের একটি বিশাল অংশ হয়ে ওঠে অপরাধপ্রবণ। তাই অল্প বয়সে তাদের অনেকেই লোভে পড়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গ্রহণ করে বিভিন্ন ড্রাগস বা নেশাজাতীয় দ্রব্য, প্রবেশ করে অপরাধের ঘৃণ্য জগতে।
বর্তমান সভ্যজগতে শিশুশ্রম অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি চিত্র। শিশুদের এ ভয়ঙ্কর অভিশম্পাতের হাত থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। তাদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দৃঢ়সংকল্পে মানবিক পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের সবাইকে। বাঁচাতে হবে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাত থেকে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম বন্ধের আশা করা অত্যন্ত কঠিন হলেও তা প্রতিরোধে অবশ্যই কার্যকর ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এই শিশুশ্রম সংক্রামক ব্যাধির মতো আরও বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের চারপাশে-এতে সন্দেহ নেই।
সম্প্রতি শিশুশ্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী শেখ ফরিদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে দারিদ্র্যতার কারণেই শিশুরা বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পরিবারের ভরণ পোষণে অংশ নিচ্ছে। শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন না হওয়া এর অন্যতম কারণ। এভাবে চলতে থাকলে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। বিশ্ব বিবেক শিশুশ্রমের বিষয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ করছে। সকলকে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভুমিকা রাখতে হবে। যে কোন দেশের সরকারের উচিত-প্রত্যেক শিশুকে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। যে সব পরিবার শিশুকে কর্মে নিয়োজিত করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এতে করে শিশুশ্রম কমে যাবে’।
এমআই