লেখক: মুহাম্মদ তাওফিকুল হাসান
ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র কিছু সময় বাকি। প্রতিদিনের ন্যায় ঘুম থেকে দেরি করে উঠলো আহমদ। মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সে। আজ সে বড্ড খুশি, কারণ জন্মদিন বলে কথা। সকাল থেকেই বাড়িতে মোটামুটি খুশির আমেজ। তার জন্য রান্না হচ্ছে হরেক রকমের বাহারি খাবার। এসব দেখে স্কুলে যেতে চাইলোনা আহমদ। মা মোটামুটি জোর করেই তাকে স্কুলে পাঠালো।
কাজের চাপ থাকায় আজ আর মায়ের সাথে যাওয়া হলোনা আহমদের। তাই, বাবার সাথে বাইকে বসেই রওনা দিলো। রাস্তায় জ্যাম থাকায়, তার স্কুলে যেতে কিছুটা দেরি হয়ে গেলো। ওইদিকে তার বন্ধু নুহান, তার জন্য প্রতিদিনের ন্যায় আসন বরাদ্দ করে রেখেছে। আহমদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে সীট ফাঁকা পেয়ে নাফি সেখানে বসে পড়লো।
কিছুক্ষণ পরেই ক্লাসে ম্যাম আসলো, সাথে আহমদও এসে হাজির। বরাদ্দকৃত জায়গা না পেয়ে, নুহানের সাথে কথা না বলে পিছনে গিয়ে বসলো আহমদ। নুহান ভেবেছিলো টিফিনে বা ছুটির পরে তার সাথে ভাব জমাবে।
নিয়মিত উপস্থিতি নেওয়া শেষে ক্লাস শুরু হলো। ক্লাসে ম্যাম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়ালেও নুহান আর নাফি মেতে আছে তাদের গল্প নিয়ে। আর ওইদিকে আহমদের মন গিয়ে আছে একটি খেলনার দিকে, লাল রঙের মেটালিক গাড়ি। গত জুমার নামাজ শেষে বাসায় আসার সময় নাকি সেটি দোকানে দেখেছিলো। বাবার কাছে হাজার বায়না ধরেও লাভ হয়নি। সেই থেকে সারাক্ষণ মায়ের কাছে গাড়ির যিকির। তার মাও তাকে বলেছিলো, সেটি পরে কিনে দিবে। হঠাৎ ছোট্ট আহমদের মনে পড়লো, "আরেহ, সোমবার তো আমার জন্মদিন, তাহলে সেদিন নিশ্চয় আব্বু আমাকে ওটা উপহার দিবে।" এই নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই।
টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টা বাজলে, সকলে টিফিন খেতে ক্যান্টিনে চলে যায়। নাফি বাইরে গেলে আহমদ নুহানের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, "তুই জায়গা রাখিস নাই, ক্যান?"
নুহান উত্তরে বলে, "রাখছিলাম রে, তুই আসিস নাই দেখে নাফি এসে বসছে। আচ্ছা, এরপর থেকে আর কাওকে বসতে দিবোনা। ওকে?"
আহমদের অভিমান কিছুটা কমলে তারা দুজনে একসাথে বসে টিফিন খেতে শুরু করে। আহমদ নুহানকে বলছে, "বিকেলে ডাকতে আসিস, একসাথে খেলতে যাবো।"
সাথে নুহানও তার নতুন কেনা ব্যাটের গল্প শুরু করে।
সময় গড়িয়ে ছুটির সময় হয়ে এলো। আহমদের আর তর সইছে না। তার বাবা হয়ত এতক্ষণে খেলনাটি কিনে রেখেছে। সে যাওয়া মাত্রই হয়ত তাকে তা দিয়ে চমকে দিবে। সারাদিন সে গাড়ি নিয়ে দিক-বেদিক ঘুরবে। তার মায়ের হাতের কেক, ফিরনি, পোলাও এর ঘ্রাণ যেনো তার নাকে ভাসছে। সে আর অপেক্ষা করতে পারছেনা।
ম্যাম ক্লাস থেকে চলে যাওয়ার পর, সে আর বেশি দেরি করলো না। নুহানকে কোনোমতো বিদায় দিয়ে, আহমদ আর নাফি মাঠের দিকে দৌড় দিলো। নাফির বোন নাজিয়াও তাদের সাথে দৌড়াচ্ছে। সেও একই স্কুলে পড়ে। আহমদ আর নাফি মাঠেই খেলাধুলা করছে। অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হবে বলে আহমদের বাবা তাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলো। নুহান আবার নাছর বান্দা, ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে এক পাও নড়বেনা।
আহমদ মাঠ থেকে নুহানকে ডাকছিলো, "তুইও চলে আয়, দেরি করতেছিস ক্যান?"
নুহান জানালা দিয়ে বললো, "দাঁড়া, নামতেছি"।
তাদের ক্লাস তৃতীয় তলায়, আর স্কুল ছুটির সময় সিঁড়িতে ভিড় হওয়ায় নুহানের নামতে কিছুটা সময় লাগলো।
সময় ১টা বেজে ১৩ মিনিট প্রায়। হঠাৎ বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলো নুহান। সাথে কানে ভেসে আসছে অগণিত মানুষের চিৎকার, কান্নার শোরগোল। সবাই চিৎকার করছে, " আগুন লাগছে, আগুন লাগছে!" নুহান কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা। তাড়াতাড়ি সিড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে তার ব্যাগ ঘাড় থেকে পড়ে গেলো। ব্যাগ রেখেই সে দৌড় দিলো। তার বন্ধুদের আবার কোনো বিপদ হলোনাতো!
ভবনের গেইটে গিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায় নুহান। সাথে চোখ দিয়ে ঝরছে অবিরাম অশ্রু। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। বিমানের মতো কি একটা যেনো দাউদাউ করে জ্বলছে তাদের খেলার মাঠে। সাথে জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে তাদের স্কুলকে। কালো ধোয়ায় ছেয়ে গেছে পুরো ক্যাম্পাস। ধোয়ার কারণে ঠিকমতো শ্বাসও নেয়া যাচ্ছে না। তাদের স্কুল ভবনটিতেও আগুন লেগেছে। আর দমকলকর্মী না আসায়, আগুন তখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গেইটেও আগুন লাগায় তা ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে আছে, সাথে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তো আছেই। এসবের তোয়াক্কা না করে, সেই উত্তপ্ত গেইট দিয়েই বের হতে যায় নুহান। আগুনের প্রচন্ড তাপ আর জলন্ত অগ্নিশিখায় দগ্ধ হয় তার মাথার চুল, দুই কান আর দুই হাত। কাপড়ে লাগে আগুনের স্ফুলিঙ্গ।
কাপড়ে লাগা হালকা আগুনটাকে হাত দিয়ে কোনরকম নিভিয়েই মাঠের দিকে দৌড়ে যায় সে। মাঠে এসে দিক-বেদিক দিশেহারার মতো খুঁজছে, আহমদ আর নাফিকে। কিছুক্ষণ আগেও তো তারা এখানে খেলছিলো, এখন এতো আগুন কোত্থেকে এলো।
অশ্রুভরা দুচোখ নিয়ে নুহান ডাকছে, "আহমদ, নাফি। ওই আহমদ। নাফিরে৷ কইরে তোরা। এ নাফি। আহমদ, ভাই তোর জায়গায় আর কাওকে বসতে দিবনা। কই তুই। আহমদ।"
নুহানের সামনে পড়ে আছে অজস্র লাশ। আগুনের উত্তপ্ততার কারণে কেউ তাদের উদ্ধার করতে এগোচ্ছে না। নুহান দেখতে পায়, দগ্ধ হওয়া শরীর নিয়ে কেউ দৌড়াচ্ছে। কেউ বা শরীরে আগুন নিয়েই হেটে চলছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে। নুহান নিরুপায়, সে তাদের জন্য কিছুই করতে পারছেনা।
কেনো সে আহমদকে, নাফিকে আটকালো না। কেনো সে তাদের ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই যেতে দিলো। এসব ভেবেই সে নিজেকে দোষারোপ করছে। ঠিক তখনি কে যেনো তারদিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। একটু কাছে যেতেই দেখে আগুনে দগ্ধ হওয়া নাফি। নিজের কথা না ভেবেই ছোট্ট নুহান এগিয়ে যায় নাফিকে বাঁচাতে।
মুহাম্মদ তাওফিকুল হাসান
শিক্ষার্থী,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি