অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুর:
ঢাকার তপ্ত দুপুর। ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনের দৃশ্য। ব্যস্ত রাস্তায় নানা যানবাহনের ভিড়ে একজন বৃদ্ধ রিকশাচালকের চোখে-মুখে ক্লান্তি আর অভিজ্ঞতার রেখা স্পষ্ট। বয়স ৭০ ছুঁয়েছে, তবুও থেমে নেই তাঁর জীবনসংগ্রাম। তাঁর নাম নুর ইসলাম। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলায় হলেও গত প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালান।
প্রতিবেদক অ আ আবীর আকাশ এর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় হঠাৎ করেই। এ বয়সেও রিকসা চালানো সম্পর্কে জানতে চাইলে অল্প সময়েই তিনি জানিয়ে দেন জীবনের অনেক গল্প, কিছু বেদনা, কিছু অভিমান। নুর ইসলাম বলেন, “ঢাকায় এসেছি তখন বয়স খুব কম। শুরুতে ভাড়া রিকশা চালাইতাম, এখনো তাই চালাই। শুধু বদলাইছে রিকশা, আগে ছিল প্যাডেলের, এখন মটর লাগানো ডিজিটাল রিকশা।”
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত—চারদেয়ালের বাইরে তাঁর জীবন। ভাড়া রিকশা চালিয়ে আয় করেন দিনে প্রায় ১৬'শ থেকে ১৮'শ টাকা। এর মধ্যে ৪'শ টাকা চলে যায় রিকশা ভাড়ায়। বাকিটা দিয়ে সংসার, খরচ আর একটু সঞ্চয়—সব সামলান। “এই বয়সেও রিকশা চালাই। সংসার থামেনি, তাই আমিও থামি নাই,” বললেন তিনি।
নুর ইসলামের পরিবার ছোট নয়। তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে ফারুক ট্রাক চালান। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট দুই ছেলে এখনো পড়াশোনা করে। তাই সংসারের খরচ চালাতে এখনও তাঁকেই পরিশ্রম করতে হয়।
চোখে-মুখে বয়সের ছাপ থাকলেও, কথায় শক্তি আর মনোবল লক্ষ্য করা যায়। “অনেক দিন হইলো ঢাকায় আছি। আগে রিকশা চালানো ছিল কষ্টের। ট্রাফিক পুলিশ টাকা না দিলে চাকা লিক কইরা দিত। এখন ধানমন্ডি এলাকায় সেই ঝামেলা নাই। একটু স্বস্তি পাই,” স্মৃতিচারণ করলেন তিনি।
ঢাকায় বছরের পর বছর কাটালেও, ভোলার লালমোহনে তাঁর মন পড়ে থাকে। এখনো মাসে একবার লঞ্চে করে বাড়ি যান। বলেন, “এক মাসে একবার যাই। নদী দেখলে মন ভালো হয়। ঢাকার মতো কংক্রিটের জঙ্গলে শান্তি নাই।”
তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল প্রথম সন্তানকে হারানো। “প্রথম ছেলে সন্তান মারা যাওয়ার পর এমন দুঃখ পাইছিলাম, ১৬ বছর গ্রামে যাই নাই,” কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে এই কথা বলতে গিয়ে। সেই দুঃখ আর শোক তাঁকে মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে দিয়েছিল যে পরিবার গড়তেও সময় লেগেছে। এখন তাঁর ছেলেমেয়েরা তুলনামূলকভাবে ছোট, তাই বার্ধক্যেও তাঁকে থেমে থাকতে হয় না।
নুর ইসলাম শুধু একজন রিকশাচালক নন, তিনি বাংলাদেশের নগরজীবনের এক জীবন্ত ইতিহাস। গ্রাম থেকে শহরে আসা শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। রাজধানীর বুকে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার পরও তাঁর গন্তব্য ঠিক হয়নি। অথচ অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। শুধু বেঁচে থাকার শক্তিই তাঁকে চালিয়ে নিয়ে যায়।
এমন মানুষেরা আমাদের সমাজের নীরব নায়ক। যাঁদের ঘাম দিয়ে তৈরি হয় শহরের দৈনন্দিন বাস্তবতা। নুর ইসলামের মতো মানুষদের জীবনের গল্পগুলো বলার জন্য খুব বেশি আয়োজন লাগে না—লাগে কেবল একটু মনোযোগ, একটু সহানুভূতি।
এমআই