মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন:
কাগজ—মানবসভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাজার বছর আগে যখন মিশরীয়রা প্যাপিরাস গাছের কান্ড থেকে লিখনযোগ্য উপাদান বানিয়েছিল, তখন থেকেই শুরু হয় কাগজের দীর্ঘ যাত্রা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আধুনিক কাগজ হলো রসায়নের এক মহৎ সৃষ্টি। প্রাকৃতিক সেলুলোজকে রসায়নের ছোঁয়ায় প্রক্রিয়াজাত করে পাওয়া যায় কাগজ—যা শিক্ষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রতিদিনের জীবনকে বদলে দিয়েছে।
কাগজ তৈরির রসায়নঃ কাগজের মূল কাঁচামাল হলো কাঠ বা উদ্ভিদজাত সেলুলোজ ফাইবার। কাঠকে প্রথমে ছোট ছোট টুকরো করে পালপিং (Pulping) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফাইবারে রূপান্তর করা হয়। এখানে আসে রসায়নের মূল ভূমিকা।
✔মেকানিক্যাল পাল্পিং: কাঠকে যান্ত্রিকভাবে চূর্ণ করে ফাইবার তৈরি করা হয়।
✔কেমিক্যাল পাল্পিং (ক্রাফ্ট বা সালফাইট প্রক্রিয়া): সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ( NaOH), সোডিয়াম সালফাইড (Na₂S), বা ক্যালসিয়াম বাইসালফাইট (Ca(HSO₃)₂) ব্যবহার করে কাঠের লিগনিনকে ভেঙে ফাইবার আলাদা করা হয়।
এই লিগনিন অপসারণ না করলে কাগজ হলদে হয়ে যায়। তাই ব্লিচিং প্রক্রিয়ায় ক্লোরিন, ক্লোরিন ডাইঅক্সাইড বা অক্সিজেনভিত্তিক কেমিকেল ব্যবহার করে কাগজকে সাদা ও উজ্জ্বল করা হয়।
এছাড়া কাগজের গুণগত মান বাড়াতে রসায়নবিদেরা বিভিন্ন অ্যাডিটিভ ব্যবহার করেন, যেমন—
✔ফিলার (যেমন ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, টাইটানিয়াম ডাইঅক্সাইড) → কাগজ মসৃণ করে, লেখার মান বাড়ায়।
✔সাইজিং এজেন্ট (যেমন আলকাইল কেটিন ডাইমার, রেজিন) → কাগজকে পানি শোষণ থেকে রক্ষা করে।
✔ডাই ও পিগমেন্ট → রঙিন কাগজ তৈরি করে।
পেপারের সাথে পরিবেশ ও সবুজ রসায়নঃ একসময় কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া ছিল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। প্রচুর পানি, শক্তি ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার হতো। কিন্তু আধুনিক রসায়ন এখানে বিপ্লব ঘটিয়েছে।ক্লোরিনের পরিবর্তে Elemental Chlorine Free (ECF) ও Totally Chlorine Free (TCF) ব্লিচিং প্রক্রিয়া এসেছে। পুনর্ব্যবহৃত কাগজ থেকে নতুন কাগজ তৈরিতে ডি-ইঙ্কিং কেমিস্ট্রি ব্যবহার হচ্ছে। বায়ো-এনজাইম ব্যবহার করে লিগনিন অপসারণ করা হচ্ছে, যা পরিবেশবান্ধব।
ভবিষ্যৎ রসায়নের সাথে কাগজের বিভিন্ন রূপঃ আগামী দিনের কাগজ আর শুধু লেখালিখি বা ছাপার উপাদান থাকবে না—বরং হবে স্মার্ট ম্যাটেরিয়াল। রসায়নের অগ্রগতির কারণে পেপার এখন নতুন প্রযুক্তির অংশ হয়ে উঠছে।
✔ইলেকট্রনিক পেপার (E-paper): ন্যানোকেমিস্ট্রি ও পলিমার কেমিস্ট্রির মাধ্যমে তৈরি হবে এমন কাগজ, যেখানে বিদ্যুৎ ছাড়াই লেখা ভেসে উঠবে, যা ই-বুক বা ফ্লেক্সিবল ডিসপ্লের জন্য ব্যবহৃত হবে।
✔বায়োডিগ্রেডেবল সেন্সর পেপার: কাগজের সাথে ন্যানোপার্টিকল যুক্ত করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কিট, খাদ্য সংরক্ষণে সতেজতা পরীক্ষক, এমনকি চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে।
✔অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল পেপার: সিলভার ন্যানোপার্টিকল বা বিশেষ কেমিক্যাল যুক্ত করে জীবাণুনাশক বৈশিষ্ট্যযুক্ত কাগজ তৈরি হবে, যা হাসপাতাল বা ওষুধের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহারযোগ্য।
✔সোলার পেপার: ফোটোভোল্টাইক কেমিস্ট্রি ব্যবহার করে কাগজকে সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী করা হচ্ছে।
কাঠের সেলুলোজ থেকে আধুনিক স্মার্ট কাগজ পর্যন্ত এর প্রতিটি ধাপে রসায়ন এক অদৃশ্য চালিকাশক্তি। ভবিষ্যতে কাগজ কেবল লেখালেখির মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশের টেকসই সমাধানে রূপ নেবে।
লেখক: মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন
শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ
সাংবাদিক, হাবিপ্রবি দিনাজপুর