মো.শাহাদাত হোসেন নিশাদ:
করোনা ভাইরাস যেখানে সব হাসি কেঁড়ে নিয়ে সব হাসি আজ মলিন করে দিয়েছে ঠিক সেই মুহুর্তে ত্যাগের মহিমা নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা আজ মানুষের মাঝে ফিরে এসেছে। যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভের আশায় ঈদুল আজহার জামাত শেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করবেন।
গতবছরের মত এবারও ঈদের আনন্দ অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস। টানা প্রায় ২ বছরের চলমান এই মহামারিতে অনেক মানুষ চাকুরী হারিয়েছেন, ব্যবসা বানিজ্য, দেশের অর্থনীতি সর্বোপরি এই পৃথিবী নামক গ্রহে হাসি নেই আজ।
আমরা আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি। সময় যতই বিরূপ হোক তবুও মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখে, আশায় বাঁধে বুক। করোনার এ ঘোর-অমানিশা শেষে আসবে নতুন ভোর। তাই এ আশাতেই স্বাগত ঈদুল আজহা।
ঈদুল আজহার অন্যতম বিষয় পশু কোরবানি। কোরবানি একটি ইবাদত। ইসলামের সকল ইবাদত ও বিধানই মানুষের জন্য কল্যাণকর। এই কল্যাণ জাগতিক এবং পরকালীন। কোরবানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম ( আ.) ও তার শিশুপুত্র ইসমাইলের ত্যাগ ও উৎসর্গের অনুপম-অনন্য ইতিহাস।
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত ইব্রাহিমের (আ.) ওপর নির্দেশ এলো তার প্রিয় পুত্র কুরবানির বা উৎসর্গের। তিনি তার পুত্রকে বলেন, ‘প্রিয় পুত্র আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার মতামত বল।’ নবীর ছেলে, ভবিষ্যতের নবী। বয়স অল্প হলেও বুঝে ফেলেন এটা মহান আল্লাহ্পাকের ওহী এবং আল্লাহর রাহে নিজেকে উৎসর্গ করার উর্বোত্তম সুযোগ। পুত্র ইসমাইল পিতা হযরত ইব্রাহিমের (আ.) ছুরির নিচে মাথা পেতে দিলেন। উৎসর্গ, স্রষ্টার দাসত্ব আর আত্মসমর্পণের এর চেয়ে বড় উদহারণ আর কী হতে পারে! পিতা-পুত্র একই চেতনা আর প্রেরণায় উজ্জীবিত। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ছুরি চালালেন একান্ত প্রিয় শিশুপুত্র ইসমাঈলের গলায়। আল্লাহ্পাকের উদ্দেশে পিতা-পুত্রের ত্যাগের কী অনন্য দৃষ্টান্ত! আল্লাহ্ খুশী হন। আল্লাহর কুদরতে পুত্রের বদলে কোরবানি হয় পশু। ‘প্রিয়বস্তু’ উৎসর্গের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হযরত ইব্রাহিম (আ.) আর ধৈর্যের পরম পরীক্ষায় পাস করেন হযরত ইসমাইল (আ.)।
এই অনন্য ত্যাগের মহিমাকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে ঈদে পশু কোরবানির মাধ্যমে। পিতা-পুত্রের সেই অমর স্মৃতিকে মানব জাতির ইতিহাসে জাগরুক রাখতে প্রতিবছর তাদের অনুসরণে পশু কোরবানির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আগত ঈদুল আজহায় সারা বিশ্বের মুসলমানরা দু’হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি করে যার যার সাধ্যমতো পশু কোরবানি করবে। ঈদুল আজহা একদিকে ত্যাগের পরীক্ষা অন্যদিকে আনন্দের উৎসব। পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর ওয়াজিব বা বিশেষ কর্তব্য।
পশু কোরবানির মাধ্যমে ত্যাগ আর উৎসর্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মহান আল্লাহ্পাকের সন্তুষ্টি অর্জনই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য।
কোরবানি দেয়া পশুর রক্ত-মাংস কিছুই স্রষ্টার কাছে পৌঁছে না, শুধু পৌঁছে তাকওয়া । অনেক মুসলিম এটি বুঝতে না পেরে ত্যাগের উৎসবকে ভোগ আর প্রদর্শনীর মহড়ায় পরিণত করে। অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বা মানুষের বাহবা কুড়ানোর জন্য কোরবানির বড় পশু কেনাটা অর্থ-বিত্তের উৎকট প্রদর্শনী বৈ অন্য কিছু নয়। এটা ধর্ম ও ত্যাগ কোনটিই নয়। এটা ভোগ আর প্রদর্শনী।
বিত্তের প্রতিযোগিতা নয়, বৈভবের প্রদর্শনী নয়, ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য বজায় রেখে কোরবানি করাই আসল কোরবানি।
পশু জবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনের পশুকেও কোরবানি দিতে পারলেই ত্যাগের পরীক্ষায় পাস করে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
এই করোনাকালে একদিকে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও সুবিধাবঞ্চিতরা জীবন ও জীবিকা উভয়ের জন্যই লড়াই করছে। এর মধ্যেও এক শ্রেণীর মানুষের লোভ আর ভোগের পেয়ালা উপচে পড়ছে। করোনায় মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে আছে কিন্তু এখনো এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের ব্যাংক ভারি করার উদ্যোশ্যে মরিয়া হয়ে আছে। অথচ তাদের পাশে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের আগামীর দিনটি কিভাবে যাবে জানা নেই। ব্যাংক ভারী করা এরা কী লোভকে দমন করে ভোগকে কমিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে? যদি না দাড়ায় তাহলে তার পশু কোরবানি বৃথা।
লোভ-লালসা, অতিভোগ, দ্রুত অবৈধভাবে ধনী হওয়ার জন্য দুর্নীতি অনেক মানুষকে আজ মানুষের মহত্তম আসন থেকে পশুরও অধম অবস্থানে নামিয়ে এনেছে। তাই তাদের আল্লাহ্ ভীতি, আত্মমর্যাদা, প্রজ্ঞা, মানুষের প্রতি মমতা-ভালোবাসা, ত্যাগের মানসিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ আজ বড় প্রয়োজন। এ বছরের ঈদুল আজহা দরদী সমাজ আর মানবিক পৃথিবী গড়ায় মানুষের ভেতরের পশুত্বকে দমিয়ে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলুক। কোরবানির মূল শিক্ষা তাদের মনে জাগ্রত হোক। তাই আসুন মনের পশুত্বকে কোরবানি দিয়ে মনুষ্যত্বকে পুনরুজ্জীবিত করি। তাহলে করোনার এই মহামারি যতই আমাদের গ্রাস করার চেষ্টা করুক ব্যার্থ হবেই৷ মানুষের সহমর্মীতায় হার মানবে অমানবিকতা নামক শব্দটি। আমাদের আশে পাশে অনেক মানুষ রয়েছে যাদের কাছে ঈদের আনন্দটা আজ বিলীনের পথে। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। প্রকাশ্যে নয়, গোপনে তাদের সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিই৷ দেখবেন মহান আল্লাহর দানীয় এক অমূল্যবান আত্মতুষ্টির ভাগিদার হবেন৷
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সময় জার্নাল/