বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায় সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বেঁচে যাচ্ছে ভ্যাকসিন নেয়ার কারণে। ষাটের দশকের পোলিও, ডিপথেরিয়া কিংবা আশির দশকের হামকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে টিকার মাধ্যমে তেমনি এই টিকার মাধ্যমে কোভিডের হাত থেকে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান যখন আমাদের উদার হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে, তখন দেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে শুরু থেকে একদল মানুষ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে যাচ্ছে। কেউ স্বপ্নে ভ্যাকসিন আবিস্কার করছে, কেউ আবার ধর্মের দোহায় দিয়ে এই ভাইরাসের এক্সিটেন্স নেই বলে দাবি করছে। আর এইসব গুজব ছড়ানোর তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে চিকিৎসক জাহাঙ্গীর। ৬ মিনিটের ভাইরাল হওয়া এক ভিডিও দেখার পর সত্যি অস্বস্তিতে পড়েছি। একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ হওয়ার পর কোভিড ভ্যাকসিনকে নিরুৎসাহী করার যে বক্তব্য তিনি দিয়েছেন, তা শুধু নিন্দনীয় নয়, রাষ্ট্রীয় বিধানে দণ্ডনীয় অপরাধ বটে।
ভ্যাকসিন বিরোধী মতাদর্শ মানুষ সারা পৃথিবীতে রয়েছে। সেটা দোষের কিছু নয়, তবে এই চিকিৎসক যেসব বক্তব্য দিয়েছে, তা যেমন ভুলে ভরা, তেমনি লজিকের কোন ভিত্তি অন্তত সায়েন্টিফিক্যালি আমি দেখি না। বরং ভ্যাকসিন নিয়ে তার যে ভুলভাল ধারনা, ইমোনলজি নিয়ে তিনি যে জ্ঞান ধারণ করেন তা হতবাক করে দিচ্ছে।
# ভদ্রলোক প্রথম বাক্যে বলেছেন, যখন কাউকে কোন রোগ-জীবাণু আক্রমণ করে তখন নাকি অ্যান্টিবডি তৈরি হয় আবার সেটা স্মৃতি কোষে থেকে যায়।
---এই বাক্যটিই ভুল। রোগ-জীবাণু শরীরে গেলেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না, সেই ধাপে যাওয়ার আগে আমাদের শরীরে প্রাথমিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা ধ্বংস করার চেষ্টা করে। যাকে আমরা সহজাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা Innate ইমিউনিটি বলছি। সেটা শরীরের চামড়া, মুখের লালা যেমন হতে পারে তেমনি কিছু কোষ যেমন লিউকোসাইট, মাইক্রোফেজ, নিউট্রফিল, ব্যাসোফিল সেইসব জীবাণুকে সরাসরি মেরে ফেলে। শুদ্ধ ভাষায় বললে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেকটায় সীমান্তরক্ষীদের মত। আর তারা ব্যর্থ হলে, সেটিকে মেরে ফেলার জন্য শরীরের দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সচল হয়, যাকে আমরা অভিযোজিত বা Adaptive ইমিউনিটি বলছি। আর এই ধাপেই মূলত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
# দ্বিতীয় বাক্যে তিনি বলেছেন, টিকা অ্যান্টিবডি তৈরি করে শরীরে ঢুকে দেয়া হয়েছে। উনি বুঝাচ্ছেন, টিকা হলো অ্যান্টিবডি যা শরীরে দেয়ার পর কোভিড-১৯ বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করছে।
---এই বাক্যটি শুধু বালখিল্য নয়, অজ্ঞতার ফসল বটে। আর অ্যান্টিবডি কোভিড-১৯ বিরুদ্ধে হয় না, কোভিড-১৯ একটি রোগের নাম, অ্যান্টিবডি তৈরি হয় সার্স-কভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ।
প্রথমত টিকা কখনোই অ্যান্টিবডি নয়, এটি মূলত ভাইরাসের সংক্রমণশীল অংশ হতে পারে আবার র্নিজীবও হতে পারে যা শরীরে প্রবেশের পর পাতানো সংক্রমণ তৈরি করে। ইমিউনোলজির ভাষায় যা হলো অভিযোজিত। শরীরে প্রবেশের ওই সংক্রমণশীল অংশটির একটি প্রতিরুপী তৈরি করে শরীরকে শেখানো হয়, এই ভাইরাসের সংক্রমণশীল অংশের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই অ্যান্টিবডি তৈরিতে মূল ভূমিকায় থাকে লিম্ফোসাইট কোষের বি ও টি-সেল। টি-সেলের একটি অংশ যাকে আমরা হেল্পার কোষ বলি, সেই কোষের সহায়তা নতুন নতুন বি-সেল তৈরি হয়। আর বি-কোষ থেকে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেই জীবাণুকে বিনাশ করে যেমন, তেমনি তা কোষের স্মৃতিতে থেকে যায়। যা পরবর্তীতে একই জীবাণু শরীরে আসলে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
# কোভিড-১৯ মিউটেটেড ভাইরাস বলে তিনি ঘোষণা দিলেন। এই বাক্যটি সঠিক নয়। সবচেয়ে কষ্টদায়ক মন্তব্য হলো, তিনি বলেছেন, বর্তমানের কোভিড ভ্যাকসিন নিদিষ্ট ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে। তার ধারনা, এই ভ্যাকসিন কেবল ওই নিদিষ্ট ভ্যাকসিন ব্যতিত অনন্য ভ্যাকসিনে সুরক্ষা দেয় না।
--ভদ্রলোক মনে হয়, বিষয়টি জানে না, বর্তমানে বাজারে থাকা ভ্যাকসিনগুলো যখন তৈরি করা হয়েছিল, তখনোই করোনার কোন মিউটেন্ট ভ্যারিন্টে আসেনি। সবগুলো ভ্যাকসিন ওয়াল্ড টাইপ সার্স-কভ-২ ভাইরাসকে টার্গেট করে করা হয়েছে। কিছু কিছু ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি সাইটে মিউটেশন হলেও অ্যান্টিবডি বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিচ্ছে বলে আমরা সায়েন্টিফিক্যালি রিপোর্ট দেখেছি। তাই তার বক্তব্য যেমন একপেষে, নন-সায়েন্টিফিক তেমনি সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি ছড়াবে।
# এই চিকিৎসক বলেছেন, এই টিকা নেয়ার ফলে শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করে ফেলে বাধা দেয়। তার মতে কোভিড ভ্যাকসিন স্পেসিফিক ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে, ফলে অন্যন্য রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে না।
--তার এই বক্তব্যের কোন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই। শরীরে ভ্যাকসিন নেয়ার পর যদি অন্যন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজ না করতো তাহলে ডাক্তার সাহেব ছোটকালে যেমন টিকা নিয়েছিলেন, তার প্রতিক্রিয়ার ফলে তিনি তো এতোদিন এই পৃথিবীর বাতাস গ্রহণ করতে পারতেন না।
যাই হোক, এইসব মানুষ আমাদের যে ক্ষতি করছে, তা পূরণ করার মত নয়। এরা সু-কৌশলে মানুষের ভিতর ভ্যাকসিন ভীতি ঢুকাচ্ছে। যা কখনোই কাম্য নয়। তার প্রতিটি কথায় যে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন, তা শুধু বিদ্বেষই ছড়াচ্ছে না, বরং একটি নিদিষ্ট এজেন্ডা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। সরকারের উচিত, এইসব মানুষদের বিচারের আওয়তায় আনা। শুধু ক্ষমা নয়, তার প্রতিটি ভুল বাক্যের কৈফিয়ত চাই। গুজব ছড়িয়ে মহামারিকে আরো শক্তিশালী করার প্রয়াস রুখতে না পারলে সামনে আমাদের বিপদ।
লেখক : জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষক।