শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

ডেল্টা কেন এত বিপদজনক?

শনিবার, আগস্ট ৭, ২০২১
ডেল্টা কেন এত বিপদজনক?

ড.  শোয়েব সাঈদ  

একের পর এক ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাবে আর দাপটে সংক্রমণের দৃশ্যপট থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে উহানের আদি কোভিড ভাইরাসটি। ১৭ মাসের লড়াইয়ে ৪২ লাখ মৃত্যু আর ২০ কোটি সংক্রমণ নিয়ে এই মুহূর্তে বিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে কোভিডের ভীতিকর উপাখ্যানের এক নতুন অধ্যায়ের মুখে। বর্তমানের  এই অধ্যায়টির নাম ডেল্টা।

ডেল্টার প্রচলিত জনপ্রিয় নাম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। গত বছরের অক্টোবরে ভারতে ডেল্টার আবির্ভাব হলেও কুম্ভমেলা আর নির্বাচন এই এপ্রিল-মে মাসে সুযোগ করে দেয় ভারতে মহা আগ্রাসন চালিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে।

বাংলাদেশ এখন এই ডেল্টার করাল গ্রাসে। রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে  সংক্রমণ আর মৃত্যুতে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন বিশ্বব্যাপী ভয়ানক উদ্বেগের কারণ। এই ডেল্টার উৎপাতে ভ্যাকসিন  সফলতার মাঝেও কোভিড কাহিনী হইয়াও হইলনা শেষ।

আগ্রহ, উদ্বেগ  আর  খুব খারাপ পরিণতির এই ৩ শ্রেণীর মধ্যে সৌভাগ্যবশত বিশ্ববাসী এখন পর্যন্ত  খুব খারাপ পরিণতির ভ্যারিয়েন্ট প্রত্যক্ষ না করলেও উদ্বিগ্ন হবার মত যে কয়েকটি ভ্যারিয়েন্টের দেখা মিলেছে তার মধ্যে এই ডেল্টা হচ্ছে সবচেয়ে বদ আর ক্ষতিকর।

চীনে এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ডেল্টা সংক্রমণে ভাইরাল লোড অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমনের চাইতে ১০০০ গুন বেশী। চীনের এ গবেষণার প্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেল্টাকে বলছে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে “ফাস্টেস্ট এবং ফিটেস্ট” অর্থাৎ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিপদজনক।

মিউটেশন বা পরিবর্তন ভাইরাসের জন্যে প্রতিনিয়ত ঘটা সাধারণ ধর্ম। অনেকগুলো মিউটেশনের ফলে একটি ভাইরাস স্ট্রেইনে কিছুটা ভিন্ন ধরণের জেনেটিক লাইনের উদ্ভব হয় যাকে ঐ স্ট্রেইনটির নতুন ভ্যারিয়েন্ট বলা হয়। ভাইরাস পোষক কোষে যেমন কোভিড ভাইরাস আমাদের দেহের কোষে প্রবেশ করে নিজেদের অসংখ্য কপি তৈরি করে। ক্রমাগত কপি করতে গিয়ে ভাইরাসের আরএনএতে কিছুটা ভুলভ্রান্তি বা ত্রুটি ঘটে থাকে যাকে আমরা মিউটেশন বলি।

ভাইরাসে মিউটেশনের ফলে এমাইনো এসিডের বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে এবং এই পরিবর্তনে ভাইরাসটি আগ্রাসী হয়ে উঠলেই বিপদ।

বেটা বা দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টে মিউটেশন E484K এর অর্থ হচ্ছে উহানের আদি কোভিড ভাইরাসটির জেনেটিক বিন্যাসে স্পাইক প্রোটিনের ৪৮৪ নম্বরে ছিল E কোডের এমাইনো এসিড গ্লুটামেট। মানবদেহে ভাইরাসের বিস্তার বা কপি করার সময় ত্রুটির ফলে অর্থাৎ মিউটেশন হয়ে গ্লুটামেটের জায়গাটি নিয়ে নিল অন্য আরেকটি এমাইনো এসিড লাইসিন যার কোড হচ্ছে K। এই মিউটেশনটি ভ্যাকসিন আংশিক ফাঁকি দিতে সক্ষম।

আলফা বা ব্রিটিশ ভ্যারিয়েন্ট B117 এর N501Y মিউটেশনটি অধিক সংক্রমণের জন্যে দায়ী। এখানে ৫০১ নম্বর বিন্যাসের এস্পারাজিন এমাইনো এসিড(N)কে সরিয়ে দিয়েছে টাইরোসিন (Y)। মিউটেশনের এই খেলায় কোভিড সংকটে আমাদের বেশ ভুগতে হচ্ছে।

ডেল্টার ক্ষেত্রে আলফার N501Y কিংবা বেটার E484K মিউটেশনটি না থাকলেও বেশ বিপদজনক অন্য কিছু মিউটেশন আছে। ডেল্টা (বি.১.৬১৭.২) জেনোমে ১৩-১৭ টি মিউটেশনের কথা বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে। সংক্রমণ সক্ষমতা, আগ্রাসন আর ভ্যাকসিন ফাঁকি দেওয়া এই তিনটি আচরণ ডেল্টাকে ক্রমশ বিপদজনক করে তুলছে।

ডেল্টার লক্ষণ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চাইতে দ্রুত প্রকাশিত হয়। আক্রান্ত হবার ৪ দিনেই লক্ষণ প্রকাশ পায় যেখানে উহানের আদি ভাইরাসে ৬ দিনে প্রকাশ পেত।

উহানের আদি ভাইরাসের সংক্রমণ সক্ষমতা যেখানে ২-৩ জন, ডেল্টায় ৬ জন। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আলফার চাইতে দেড়গুণ বেশী সংক্রামক এবং উহানের আদি টাইপটি থেকে  সংক্রমণ সক্ষমতায় দ্বিগুণ শক্তিশালী।

ডেল্টায় মিউটেশন D614G অধিক স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে মানব কোষের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে শক্তভাবে আটকে থাকার দক্ষতায় সংক্রমণ সক্ষমতাকে অনেক বৃদ্ধি করে।

ডেল্টা সংক্রমণে গলা আর ফুসফুসে অনেক বেশী ভাইরাল লোড হয়। ধারণা করা হচ্ছে মিউটেশন P681R গলায় আর ফুস্ফুসে অধিক ভাইরাল লোডের জন্যে দায়ী।

মিউটেশন L452R কে এন্টিবডির কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার প্রবণতা উসকে দেবার জন্যে দায়ী করা হয়।

ডেল্টা যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমশ প্রধান ভ্যারিয়েন্ট হয়ে উঠছে; ক্যালিফোর্নিয়াতে এখন ৮৫% ই ডেল্টা। যুক্তরাজ্যে ডেল্টা সংক্রমণ মোট সংক্রমণের ৯০%।

যুক্তরাজ্যে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে উহানের আদি রূপের ভাইরাসের  চেয়ে  ডেল্টার উপসর্গের  স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। শুকনো কাশি আর স্বাদ না পাবার উপসর্গের বদলে এখন ডেল্টায় জ্বর, মাথাব্যাথা,  গলা ব্যাথা, নাক দিয়ে পানি পড়া হচ্ছে দৃশ্যমান উপসর্গ। কিছু রিপোর্টে ডেল্টার সাথে কানে কম শুনা, আন্ত্রিক সমস্যা, টিস্যু মরে যাওয়া, গেংগ্রিনের সংযোগের কথা বলছে।

ডেল্টা নিয়ে এত হতাশার মধ্যে আশার আলো হচ্ছে ভ্যাকসিন। আপাতত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আর মাস্ক বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের নাম ভূমিকায় থাকলেও আমাদেরকে অবশ্যই শক্তিশালী টিকাদান কর্মসূচীর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৫০% মানুষ ডাবল ভ্যাকসিনেটেড। ভ্যাকসিনের সফলতার মাঝেও ডেল্টার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড এখন টিকা না দেওয়া/নেওয়া জনসংখ্যার জন্যে মহামারি হয়ে উঠছে।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণা বলছে ফাইজার মডার্নার ডাবল ডোজে ডেল্টা থেকে প্রতিরক্ষা ৮০% আর সিঙ্গেল ডোজে  ৩১%।  তথ্য আছে কোভিশিল্ডের ডাবল ডোজে ডেল্টায় প্রতিরক্ষা ৬০% এর উপরে। ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকলেও গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত খুবই কার্যকরী।

মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাসের এন্টিবডির কার্যকারিতা কমিয়ে দেবার অনেক কৌশল থাকলেও  এই কৌশলগুলো খুব যে সফল তেমন কোন প্রমাণ নেই। আলফা, বেটার চাইতে ডেল্টা এই ফাঁকির ক্ষেত্রে কিছুটা অধিক সফল হলেও ভ্যাকসিনের সেফটি নেটে  বিশেষ করে ডাবল ডোজে কিন্তু দিনশেষে আটকে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে।  আর তাই ডেল্টা সংক্রমণেও ডাবল ডোজ ভ্যাকসিনেশন আমাদের আশার আলো।

লেখক : কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজিস্ট। কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে  ডিরেক্টর পদে কর্মরত।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল