শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

ডাক্তার যখন রোগী

রোববার, আগস্ট ২৯, ২০২১
ডাক্তার যখন রোগী

ডা. মতিউর রহমান অর্থো :

কখনো রোগে ভুগেনি এমন মানুষ পাওয়া বিরল ঘটনা । ডাক্তার  মানুষকে চিকিৎসা প্রদান করেন। অনেক  রোগ ঔষধের দ্বারা সারে, অনেক রোগের জন্য শল্য চিকিৎসারও প্রয়োজন হয়। ডাক্তার অতিসহজেই নিজের রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করেন এবং রোগীর মনোবল শক্ত রাখার জন্য নানান রকম উপদেশ দেন।  উপদেশ বিতরণের মতো সোজা কাজ আর নেই, কথাটা বেশ প্রচলিত। ঘরের মানুষ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনরা, বাসার কাজের লোক, অফিসের কলিগ, হুজুর, পীর ফকির সবাই উপদেশ বিতরণে পারঙ্গম। 

বাংলাদেশের ডাক্তারগণ রোগীকে সময় দেয়না, এরকম ধারণা রোগী মহলে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে। যারা উপদেশ দিতে আনন্দ পায় তারা উপদেশ শোনতে পছন্দ করেন না। ডাক্তারের কাছে এসে রোগী তার মনের কথা নির্ধিদায় বলতে চায়। ডাক্তার ও রোগীর মাঝে কথা বিনিময়ে কোথায় যেন একটা প্রতিবন্ধকতা আছে তা বলা যায়। রোগী এবং ডাক্তার পরস্পর বান্ধব না হলে রোগীর মনে একধরনের হতাশার জন্ম নেয়। যার জন্য রোগী আস্থাহীন হয়ে একের পর এক ডাক্তার বদল করে। অনেকে সময় সুযোগ করে বিদেশেও চিকিৎসা নিতে যায়। 

ভারতের একটা প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে রিসিপশন থেকে শুরু করে প্রেসক্রিপশনের আদিঅন্ত বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ পারদর্শী লোক দেখতে পেয়েছি। রোগীকে পরীক্ষা করা হয় স্টেপ বাই স্টেপ। জুনিয়র ডাক্তার রোগীর নামধাম, ঠিকানা, রোগের লক্ষণ, রোগের ইতিহাস, ঔষধের ইতিহাস সব লিখে সিনিয়র ডাক্তারের কাছে অনলাইনে প্রেরণ করেন। সিনিয়র ডাক্তার পুনরায় রোগীর কাগজপত্র দেখে, রোগীর সাথে কথা বলে জুনিয়র ডাক্তার কর্তৃক প্রেরিত ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে দেখেন। এগুলোর মধ্যে কোন গরমিল থাকলে তিনি তা শোধরে নেন। 

এরপর আসে রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পালা।ডাক্তার  ধীরে সুস্থে রোগীকে পরীক্ষা করেন। প্যাথলজিকেল বা অন্য পরীক্ষা লাগলে তা লিখে দেন।যা সেখানেই হয়। অন্য কোথাও যেতে হয়না। পরীক্ষার রিপোর্ট ও  ক্লিনিকেল ফাইন্ডিং দেখে ডাক্তার  ঔষধ লিখে দেন। ডাক্তার নিজে বুঝিয়ে দেওয়ার পরও একজন কাউন্সিলর আবার বুঝিয়ে দেন। বাংলাদেশে অনেক হাসপাতালে এরকম ব্যবস্থা হয়তো আছে,হয়তোবা নেই। এর কারণ প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব। 

কথায় আছে ডাক্তারগণ  খারাপ রোগী।ডাক্তার  অন্যের চিকিৎসা প্রদান করতে করতে নিজের অসুখের কথা ভুলে যায়। আপন খবর রাখা ডাক্তারের জন্য কঠিন কাজ। ডাক্তার যখন অন্য ডাক্তারের কাছে রোগী হয়ে যায় তখন ধরে নিতে হবে তিনি প্রকৃত অর্থে কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগী। সামান্য অসুখ বিসুখের চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তার কখনো অন্য ডাক্তারের দ্বারস্থ হয় না। 

ডাক্তার কারো কাছে রোগী হয়ে গেলে টাকা খরচ করতে কার্পণ্য করেননা। অনেক ডাক্তার ডাক্তারের কাছে থেকে ফি নেন, অনেক ডাক্তার নেননা। যা ডাক্তার বিশেষের ব্যাক্তিগত বিষয়। বাংলাদেশের কোন বড় হাসপাতাল ডাক্তার বা তার পরিবারের কাছ থেকে প্রাপ্য  সব টাকা রাখেন। এতে দোষের কিছু নেই। অনেক টাকার ব্যবসা, অনেক টাকা কামাই করেই তা উশুল করতে হবে। প্রশ্ন আসে সেবার মান নিয়ে। কোন প্রশ্ন করলে পরিচালনার দায়িত্বরতদের অন্য দিকে তাকিয়ে থাকা নিয়ে। ভারতের সাথে এখানেই পার্থক্য। ভারতের ডাক্তার আমার কাছ থেকে কোনো ফি নেননি। 

আমার শরীরের উপর অনেক দখল গেছে। ইতিপূর্বে তিনবার অজ্ঞান হতে হয়েছে চিকিৎসার প্রয়োজনে। একবার এপেন্ডিক্স কাটতে হয়েছে, আরেবার নাকে অপারেশন করতে হয়েছে, শেষবার এক্সিডেন্ট পরবর্তী লেপারেটমি করতে হয়ছে। আরেকবার অজ্ঞান হয়ে অপারেশন করতে হবে। অজ্ঞান হওয়া ও অপারেশন আমাকে ছাড়ছেনা। ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসা নেওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক। আমি ডাক্তারদের বদান্যতায় ও উপরওয়ালার কৃপায় বেঁচে আছি। কত ডাক্তার কত রকম কথা বলেছে, কত কিসিমের ব্যবহার করেছে সব আমার মনের খাতায় লেখা আছে। মানুষ বিচিত্র স্বভাবের প্রাণী, তার স্বভাব ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন। মানুষের ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রতাকে মেনে নিয়েই চলতে হয়। 

আমি নিজে একজন ছোট মাপের শল্য চিকিৎসক। কত মানুষের শরীরে ছুরি চালিয়েছি তা হিসাব করে বলা যাবে না। অনেক মানুষের মৃত্যুকালীন  স্বাক্ষীও আমি।  শতশত  রোগীর স্বজনের কান্না আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়। আমি যখন একান্তে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হই তখন আমি সাধারণ মানুষ বই কিছু নই। আমি ডাক্তার হলেও বাস্তবে একজন অতি সাধারণ মানুষ। আমার দুঃখ বেদনা, পাওয়া নাপাওয়ার হিসাব সাধারণ মানুষের মতো। আমি রোগীর স্বজন হিসেবে হাসপাতালের বারান্দায় পার করেছি অনেক রাত। ডাক্তার ও হাসপাতালের স্টাফদের গলা ধাক্কা খাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে আমার। 

শাশুড়ী তার অতীতের প্রাপ্ত  তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রতিশোধ ছেলের বউয়ের উপর  ঝাড়ে। যা পরম্পরায় চলে। হাসপাতালে অনেক ডাক্তারকে দেখেছি যারা ঝাড়ি মারতে কোনো রকম কসুর করেন না। আমি চাকরি জীবন পার করে অবসর জীবন যাপন করছি। নানান অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, যেগুলোর মধ্যে তিক্ত অভিজ্ঞতার চেয়ে ভালো অভিজ্ঞতার পরিমাণ বেশি। ডাক্তারের কাছে টাকা আসে যৌবনের যখন সমাপ্তি ঘটে তখন। উচ্ছল তারুণ্য ও যৌবন চলে যায় পড়াশোনা করতে করতে। ডাক্তার তার উপার্জন করা টাকা ভোগ করতে পারে না। নেশার বশে  ডাক্তার নিজের সুখ ভুলে রোগী দেখে টাকা রোজকার করে। ডাক্তার দ্বারা যে সকল কর্পোরেট সেন্টার  লাভবান হয় তাদের গায়ে কেউ দোষ চাপায়না। যত দোষ নন্দঘোষ ডাক্তারের। 
জুনিয়র ডাক্তারগণ আশাহত হয়ে নানান কথা বলেন। সিনিয়র ডাক্তারদের দোষ দেন। সমালোচনার মধ্যে দিয়ে ভালো কিছু আসে। আমরা যারা সিনিয়র তারাতো সাইড লাইনে আছি। সামনে যারা আছে তাদের উপর ভর করে চিকিৎসা ব্যবস্থা আলোর মুখ দেখবে। ডাক্তার নিজে রোগী হলে আরেকজন ডাক্তারের কাছ থেকে ন্যায্য সম্মানটুকু আশা করে । তা আশা করা দোষের কিছু নয়।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল