রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

জাপানের মৃত্যুদণ্ড এবং কার্যকর পদ্ধতি

বুধবার, সেপ্টেম্বর ১, ২০২১
জাপানের মৃত্যুদণ্ড এবং কার্যকর পদ্ধতি

আশির আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, কিউস্যু ইউনিভিার্সিটি, জাপান :

জাপানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কিভাবে? ফাঁসি? ইনজেকশন? গুলি? ইলেকট্রিক চেয়ার?
-ফাঁসি। তবে ফাঁসি দেয়ার প্রস্তুতি টা ইউনিক।

২০০৫ সালের কথা। এন,টি,টি কমিউনিকেসান্স এ চাকুরী করি। বসের সাথে কথা হচ্ছিল, এক আড্ডায়। জাপানের ক্রাইম, মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। জাপানে মৃত্যুদণ্ড কীভাবে কার্যকর হয় তা নিয়ে হাসতে হাসতে লোম-হর্ষক বর্ননা দিলেন। সেই রাত আমার ঘুম হলোনা, বার বার মনে হচ্ছিল ফাঁসির মঞ্চে আমি দাঁড়িয়ে আছি।

ফাঁসির রায় আর কার্যকর হবার মাঝখানে বিরাট লম্বা সময় থাকে। কারো ১ বছর কারো ২০-৩০ বছর। তবে যেদিন কার্যকর হবে সেদিনই সকাল ৯ টায় আসামিকে জানিয়ে ১০ টার মধ্যে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তার মানে মাত্র ১ ঘণ্টায় আপনি এই দুনিয়া থেকে অন্য দুনিয়ায়। যদি বলা হয়, ভাইজান/বুবুজান- আপনার হাতে আর ১ ঘণ্টা সময় আছে, কী কী করতে চান? যতই ভাববেন পৃথিবীর প্রতি ততই মায়া বেড়ে যাবে। আপনার কষ্টের কথা বিবেচনা করেই জাপানে নিম্নলিখিত স্টেপ গুলোর মাধ্যমে অতি দ্রুত কাজটিকে সমাধা করে ফেলেন।

প্রথমেই আপনাকে নিয়ে যাবে জেলের ভেতরের একটা প্রার্থনা কক্ষে। বৌদ্ধ ধর্মের একজন পাদ্রী আসবেন। তওবার মত কিছু বাক্য পড়াবেন।

শেষ ইচ্ছা পূরণ করার সীমিত কিছু সুযোগ দেবেন। বিস্কিট জাতীয় শুকনো খাবার অথবা ফল খেতে পারেন, কেউ নিজের সম্পত্তির উইল লেখেন। আপনি বিবাহিত পুরুষ হলে স্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পাবেন। টেনশন কমানোর জন্য কোন কোন কারাগারে সিগারেট খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।

সাদা পোশাক, সাদা টুপি (মুখ ঢাকার জন্য), আর হাতকড়া পড়িয়ে মঞ্চে নিয়ে যাবেন। মঞ্চ বলতে একটা জাপানিজ স্টাইলের তাতামি রুম। রুমে একটা কাঁচের জানালা থাকে, সাক্ষীদের জন্য। মৃত্যু সাক্ষী। মাঝখানে একটা পাটাতন। সিলিং থেকে দড়ি ঝুলানো। পাটাতনের নিচে আরেকটা অন্ধকার রুম। পাটাতন সরিয়ে নিলেই যাতে অন্য রুমে/জগতে চলে যেতে পারেন। জল্লাদ এসে গলায় দড়ি পড়িয়ে দেবেন। পা বেঁধে দেবেন। রুমের সাউন্ড বক্স থেকে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের স্তবক বাজতে থাকবে। একটা ধর্মীয় ধর্মীয় ভাব।

পাটাতন সরিয়ে নেবেন একটা অভিনব যান্ত্রিক উপায়ে। ৫ কন্ট্রোল রুমে ৫ টা বাটন থাকে। ৫ জন জল্লাদ একই সঙ্গে ৫ টা বাটন টিপ দেবেন। একটা বাটন কাজ করবে। কোন বাটনটা কাজ করলো তা কেউ জানেনা, জানবে না।

পাটাতন সরিয়ে নেয়া মানে হল ভর (m) আর অভিকর্ষজ ত্বরণে (g) যে বল (F) তৈরি হয় তাতে সেই বল/ বেগে নীচে পড়ে যাওয়া। আপনি যত মোটা, কাজ তত স্পীডে ঘটবে। মোটা মানুষের এই অ্যাডভান্ট্যাজের কথা কোন ডাক্তারকে প্রেস্ক্রাইব করতে শুনিনি। চিকন হন আর মোটা হন, আপনাকে ঝুলিয়ে রাখবে ৩০ মিনিট। ডাক্তার এসে চেক করে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করবেন। এই একটা ইউনিক সার্টিফিকেট যা আপনার নিজের জীবনে কখনো কাজে লাগবে না, আপনার CV তে দুইলাইন যোগ হবে না।

জীবনের শেষ অর্জনটি পরের জন্য রেখে যেতে পারলেন।
...প্রত্যেকেই আমরা পরের তরে।

উফুঁফফফফফফ- ফা। এই হচ্ছে কাহিনি।

কিছু FAQ দিচ্ছি -

১। ফাঁসির রায় আর কার্যকরের মাঝখানে এত লম্বা সময় কেন?

কোর্ট থেকে রায় হবার পর আসামি জেলে বসবাস শুরু করেন। কারো ডাক আসে ১ বছরের মাথায় কারো ২০-৩০ বছর পর। গড়িমসিটা করেন কারা কর্তৃপক্ষ। কারা প্রধানরা নিজের আমলে এই অপ্রিয় কাজটা করতে চাননা। জাপানে মাত্র ৭ টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে। এই কারাগারগুলোতে আসার পরপরই বদলির জন্য তদবির করতে থাকেন কারা প্রধানরা। যে সব আসামির আত্মীয় স্বজন দেখা করতে আসেন না, তাদের ঝুলানোর প্রায়োরিটি আগে। আগে যাইবার চাইলে আত্মীয়স্বজন (FnF) এর সাথে সম্পর্ক কাট করেন।

২। ফাঁসির কার্যকরের নির্দেশ শোনা মাত্র আসামির মনের অবস্থা কেমন হয়?

জানিনা। আপনি জানেন? এরকম অভিজ্ঞতা একটা বিরল জিনিস হবার কথা।
তবে আসামি কিভাবে বহিঃপ্রকাশ করেন তার কিছু নমুনা আছে। জাপানের অধিকাংশরাই ঠাণ্ডা মাথায় মঞ্চে এগিয়ে যান। কেউ কেউ চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেন। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।

৩। জল্লাদের সংখ্যা ৫ জন কেন? ওনাদের ইনসেন্টিভ কি?

আমাদের দেশে দাগি আসামিদের জল্লাদ বানানো হয়। ইনসেন্টিভ হিসাবে ওনাদের নাকি শাস্তি কমিয়ে দেয়া হয়। জাপানে কেউ জল্লাদ হতে চান না। সুস্থ মস্তিষ্কে আরেকটা মানুষ খুন করার দায়িত্ব এড়াতে চান। সারা জীবন নাকি একটা প্রশ্ন জীবন্ত খোঁচাতে থাকবে “তুই খুনি, তুই মানুষ মেরেছিস, তুই মেরেছিস, তুই খুনি”। এই প্রায়শ্চিত্ত থেকে খানিকটা রেহাই দেয়ার জন্যই এরকম র‍্যান্ডম ৫ বাটন ডিজাইন করা। মনে খুঁতখুঁত থাকার সম্ভাবনা ৫ ভাগের ১ ভাগ হয়ে যায়।

এক বাটন টেপার জন্য জল্লাদ ফি হলো বিশ হাজার ইয়েন (২০ হাজার টাকার মত)। তবে এই টাকা নাকি ওনারা রাখেননা, সরাসরি মন্দিরে দিয়ে দেন।

মানুষ দিয়ে মানুষ মারার আয়োজন নিয়ে কিছু ট্রিভিয়া (জেনে লাভ নেই, না জানলেও ক্ষতি নেই) দেই-

১। পৃথিবীতে বছরে সাজা হিসাবে ৫৫০০ লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তাঁর মধ্যে ৫০০০ ই চীনদেশে। বাকি ৫০০ সারা বিশ্ব একাদশে। জাপানে ক্রাইম রেট এমনিতেই কম। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা এক ডিজিটের কোঠায়- ২০১৪ সালে ফাঁসি হল মাত্র ৩ জনের।

২। চীনে ফাঁসির চেয়ে গুলি ব্যবহার হয় বেশী। আসামির শরীরের কিডনি, চোখ জাতীয় অরগ্যান গুলো রিসাইকল করতে নাকি সুবিধা।

৩। সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ডের কিছু ভিডিও দেখে ফেলেছিলাম। নাহ, এই কাহিনি মনে করতে ইচ্ছে করছে না। কয়েক বছর আগে কয়েকজন তরুণ বাংলাদেশীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল মক্কার এক মসজিদ সংলগ্ন খোলা মাঠে। কত আগে তাদের জানানো হয়েছিল তা জানিনা। সকালে এক ছেলে তার মা কে ফোন করে বলেছিল, মা আজ আমার গলা কাটবে। উফুঁফফফফফফ-ফা।

৪। একবার ফিলিপাইনের করিহেডর দ্বীপে গিয়েছিলাম। জাপানীরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সেখানে কি করেছে জানেন? দ্বীপ দখলে রেখেছিল আমেরিকান বাহিনী। জাপানীরা চিকন বুদ্ধি দিয়ে আমেরিকানদের হটিয়ে করিহেডর দ্বীপ (যা ম্যানিলার গেট ওয়ে ছিল) দখল করে নেয়। শক্ত আমেরিকান সৈনিক গুলোকে মেরে ফেললো- নরম গুলোকে রেখে দিল। দ্বীপে খাদ্য সরবরাহ না থাকায় বাকিগুলোকে কেটে সুসি-সাসিমি বানিয়ে খাওয়া শুরু করে দিল। পরে আমেরিকানরা পাল্টা আক্রমণ করলে জাপানীরা দলে দলে আত্মহত্যা শুরু করে।
মরুম মরুম
নিজে মরুম
তোর হাতে মরুম না।

৫। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইউরোপে ইহুদি-নির্মুল অভিযান শুরু হল। এত লোক ম্যানুয়েলি মারা অনেক কষ্টসাধ্য, ব্যায়সাপেক্ষ ব্যাপার। জার্মানরা ব্যাপারটাকে cost-effective করতে চাইলেন। দলে দলে ইহুদিদের ধরে বিরাট এক ঘরে ঢুকিয়ে বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দিলেন। ব্যাস। কারো হাত ময়লা করতে হলোনা।

রুমে ঢুকানোর আগে সবাইকে পোশাক খুলিয়ে তিনটি লাইনে ভাগ করে দিলেন। যাদের শরীরে চর্বি বেশী তাদের আলাদা লাইন, যাদের দাঁত সোনায় মোড়ানো তাদের আলাদা লাইন। সোনায় মোড়ানো দাঁত গুলো কাজে লাগানো হল। মেদ ওয়লা মানুষের মেদ থেকে সাবান বানানো হল।

৬। মধ্য যুগে ইউরোপে গিলেটিনে লোকসম্মুখে কতল করে দিতেন। দাগি আসামিদের হাতে পায়ে চার দিকে চার ঘোড়া লাগিয়ে ৪ হর্স পাওয়ারে টান দিয়ে হাত পা ছিঁড়ে দিতেন। মোঘল আমলে নাকি একই পদ্ধতিতে হাত পা ছিঁড়ে হাতি দিয়ে মথে দেয়া হত। তাজমহল বানিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। তার বড় ছেলে দারাসিকোকে মেরে সিংহাসন নিলেন ছোট ছেলে আওরঙ্গজেব। আপন বড় ভাই দারাসিকো কে ঘোড়ার গাড়ির পিছনে বেঁধে দিলেন। গাড়ি চলল। সবাই দেখল। দারাসিকো মরল।
উফুঁফফফফফফ-ফা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বসলো। টোকিও ট্রাইবুন্যাল। আসামিদের কোন রকম আপিল ছাড়াই দলে দলে মৃত্যুদণ্ড আর ফাঁসি দেয়া হচ্ছিল । জাজ প্যানেল এর একজন এই প্রক্রিয়াতে বাঁধা দিয়ে বসলেন। ওনার নাম রাধা বিনোদ পাল । আমাদের কুষ্টিয়াতে জন্ম। আন্তর্জাতিক জাজদের বিরুদ্ধে একাই লড়লেন। বিচারকার্য স্থগিত করে দিলেন। বেঁচে গেলেন অনেক নিরীহ জাপানিজ। কয়েক মাস সময় নিয়ে ১২৩৫ পৃষ্ঠার এক পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিলেন। সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে জাপানীরা আইনে লড়লেন। জাপানীরা বিনোদ পালের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ হয়ে গেলেন। টোকিও এবং কিয়োতো শহরে বিনোদ পাল এর মুর্তি বানিয়ে স্মরণীয় করে রাখলেন। তবে উনি পরিচিত ভারতীয় হিসেবে। বাংলাদেশী হিসেবে নন।

নাহ আর লিখতে ইচ্ছা করছেনা। মানুষ দিয়ে মানুষ মারার আয়োজন- কবে যে শেষ হবে।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল