মাহবুবুল হক খান। দিনাজপুর : লাল হলুদ শাড়ী আর খোপায় রঙ্গিন সাজে বাদ্যের তালে নেচে গেয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি উরাওঁ সম্প্রদায় উদযাপন করেছে তাদের বড় পরব কারাম উৎসব। দিনাজপুর শহরের সুইহারী খালপাড়ায় আদীবাসি পল্লীতে সারারাত এ উৎসব পালন করা হয়। অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে বের হয়ে নিজেদের ঐতিহ্য মেলে ধরতে এ আয়োজন করা হয়।
১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল পর্যন্ত নেচে গেয়ে এই উৎসব ালন করে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির নারী-পুরুষ মাদল আর মন্দিরার শব্দের সাথে দলবদ্ধ হয়ে পথ নৃত্যে অংশ নেয়। তাদের নিজস্ব ভাষায় গাওয়া গান আর ছন্দময় নাচে অংশ নেয় তরুন-তরুনী আর আবাল-বৃদ্ধরা। সমতল ভুমির ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির বিভিন্ন জাতিসত্বা নেচে গেয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরেন তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃৃিতকে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ এ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে ঢল নামে নানা পেশার মানুষের।
কারাম উৎসবটি উরাওঁদের বছরের সবচেয়ে বড় পর্ব হিসাবে বিবেচিত। এ উৎসবটি ভাদ্র (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসের একাদশী দিনে পালন করা হয়ে থাকে। যখন পৃথিবীতে মৌসুমি বায়ু চরমে থাকে এবং ধানের গাছগুলো মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে ও ধানের গাছ কান পর্যন্ত বড় হয় ঠিক তখন এ উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। এটি মূলত ধান কাটার আগে এবং অবসর সময়ে “প্রচুর ফসল উৎপাদনক্ষম উৎসব” ও শস্য মাঠে দাঁড়ানোর শক্তি যোগানোর জন্য করা হয়ে থাকে।
কারাম প্রধানত ৩ ধরনের করা হয়। জিতিয়া কারাম যা ব্যক্তিগত পর্যায় করা হয়, দাশ কারাম যা গ্রামের সকলে মিলিতভাবে উদযাপন করে থাকেন ও রা-জি কারাম বা রাইজ কারাম যা এলাকার সকলের সমন্বয়ে করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও কারামে গ্রামবাসী গ্রামের যুবক-যুবতীদের সুসন্তান লাভের জন্যও প্রার্থনা করা হয়। কারাম উৎসবের প্রধান অনুষ্ঠানটি কারাম গাছের তিনটি ডাল কেটে গ্রাম্য আখড়ার মাঝখানে কারাম রাজা হিসাবে গ্রামের নারীদের দ্বারা পোতা হয়। ডালের চতুর্দিকে বসে কারামের কাহিনী শোনা হয়। এরপর গ্রামের ছেলে-মেয়েরা কারাম রাজার চর্তুদিকে সারা রাত ধরে নাচানাচি করে রাতের শেষে নাচানাচি বন্ধ করে।
পরের দিন সকালে যুবতী মেয়েরা বিশেষভাবে গোজানো জাওয়া পুঁপ তাদের ভাই ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিতরণ করে। সকালের সুর্যের তাপ বাড়ার সাথে সাথে পাহান কারাম ডালগুলো তুলে কাছাকাছি পুকুর বা নদীতে সম্মানের সাথে ভাসিয়ে দেয় এবং পারিবারিক ভোজে অংশগ্রহণ করে। ঐতিহাসিকগণের বর্ননায় জানা যায় যে, বহুদিন পূর্বে পাটনার রোহিতাসগড় হতে আর্যদের দ্বারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উরাওঁরা প্রাণ রক্ষার্থে তাদের আশ্রয়স্থান ত্যাগ করে পালাতে থাকে এবং আর্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করতে থাকে। অনেকদূর আসার পর ক্লান্ত উরাওঁরা একটি কারাম গাছের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করলে আশ্চর্যজনকভাবে আর্যরা ফিরে যায় এবং উরাওঁরা বিপদমূক্ত হয়। তাদের বিশ্বাস এ কারাম বৃক্ষ উরাওঁদের রক্ষা করেছে। এ বিশ্বাস থেকেই সেদিন উরাওঁরা কারাম বৃক্ষের উপাসনা করে আসছে এবং উরাওঁরা এ স্মৃতি স্মরন করে মর্যাদাসহকারে এ উৎসবটি পালন করে থাকে।
সময় জার্নাল/আরইউ