গোলাম আজম খান, কক্সবাজার অফিস :
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন' নিয়ে বেশ তৎপর ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন জাতিকে নিয়ে নিজ দেশে ফিরতে। দেশী বিদেশি মিডিয়ার সাংবাদিকদেরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেয়া মিয়ানমারে নির্যাতনের কাহিনি শুনাতে গিয়ে কেঁদেছিলেন বহুবার। ১৫ জন সদস্য নিয়ে তিনি গড়ে তোলা ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানরাইটস’ (এআরএসপিএইচ)। সংগঠনের ব্যানারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছিলেন তিনি। মুহিবুল্লাহর স্বজনদের এমনতাই দাবি করে আরও বলেন, "স্বদেশে প্রত্যাবাসন তৎপর হওয়ায় খুন করেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে"।
গেল বুধবার দিবাগত রাত ২টার দিকে মুহিবুল্লাহ মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন তার মেঝ ভাই হাবিবুল্লাহ, ছোট ভাই আহম্মদ উল্লাহ ও মুহিবুল্লাহর প্রতিবেশী নুরুল আমিন।
এ সময় মুহিবুল্লাহর ছেট ভাই হাবিবুল্লাহ বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনা বাহিনীর নির্যাতনের কারণে প্রাণ বাঁচাতে মুহিবুল্লাহসহ আমাদের ৩ ভাই পরিবার নিয়ে পালিয়ে উখিয়ায় চলে আসি। মুহিবুল্লাহ পরিবারে রয়েছে স্ত্রী ও ৯ সন্তান। যার মধ্যে মেয়ে রয়েছে ৫ জন ও ছেলে রয়েছে ৪ জন।
মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘উখিয়া কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পে এশার নামাজ শেষ করে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর অফিসে অবস্থানকালে ২০/২৫ জনের একটি বন্দুকধারী দল আমার ভাইয়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। ওই অফিসে কর্মরত অন্যান্যদের মারধর করে ছেড়ে দিলেও ভাইয়ের বুকে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা।
তিনি আরো বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমার ভাই এগিয়ে আসতেন। তাদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলেন। শুধু এখানে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও আমার ভাইয়ের পরিচিতি ছিলো। হয়তো সেই যাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে এ হামলা এবং তাকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘাতকদের শাস্তির দাবি জানাই।
কথা হয় তার আর এক ছোট ভাই আহম্মদ উল্লাহ সাথে। তিনি বলেন, মুহিবুল্লাহ ভাই বাড়ির কাছেই অফিসে ছিল। দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সবাই। গুলির পর ভাই মাটিতে পড়ে যায়, তখন সবাই দৌড়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে যায়। মুহিবুল্লাহ ভাইয়ের গার্ডরাও পালিয়ে যায়। তারপর আমরা গিয়ে মুহিবুল্লাহ ভাইকে মাটি থেকে তুলে প্রথমে ব্লকের হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে থেকে পরে এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মুহিবুল্লাহ ভাইয়ের গায়ে গুলি লেগেছে ৪টি। বুকে ৩টি ও হাতের বাহুতে একটি।
আহম্মদ উল্লাহ আরও বলেন, যারা গুলি মেরেছে তাদের কয়েকজনকে চিনেছি। তারা মোট ১০ থেকে ২০ জন ছিল। প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছিল ভাই। তাই তাকে মারা হয়েছে।
প্রতিবেশী নুরুল আমিন বলেন, রোহিঙ্গাদের সবার শান্তি চেয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। মিয়ানমারেও থাকাকালে সবাই মুহিবুল্লাহকে ডাকত শান্তির বাপ। শান্তির বাপ মানে হচ্ছে; মানুষ যে কোনো জায়গায় বিপদ পড়লে মুহিবুল্লাহ সেই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করত। কোনো ধরনের টাকা ছাড়া। তাই মানুষজন মুহিবুল্লাহর নাম দিয়েছিল শান্তির বাপ।
নুরুল আমিন আরও বলেন, অনেকেই শান্তি চায় না, অশান্তিই ভালো লাগে; পৃথিবী তো এখন এমনই হয়ে গেছে। সত্য কথা বলার লোক পৃথিবীতে নেই। যতই মিথ্যা কথা বলা যায় ততই ভালো। সত্য কথা বলা এবং সবার শান্তি চাওয়া কারণেই হত্যা করা হয়েছে মুহিবুল্লাহকে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কে এই মুহিবুল্লাহ? কিভাবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতা হলেন তিনি? ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় এসেছিলেন মুহিবুল্লাহ। সে সময় তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, ‘আমরা (রোহিঙ্গারা) দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। এ বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাই।
এর আগে তিনি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গার গণহত্যাবিরোধী যে মহাসমাবেশ হয়েছিল, তা সংগঠিত করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। গণহত্যাবিরোধী ওই সমাবেশ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিল। ওই সমাবেশে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের নাগরিত্ব প্রদান, নিরাপত্তা, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটা ফেরতসহ কয়েকটি দাবি পূরণ না রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। এখনো ওই দাবিতে অনড় রয়েছে রোহিঙ্গারা। এরপর তিনি
উখিয়া-টেকনাফের ৩২ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে ছিলেন। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে দক্ষ মুহিবুল্লাহ ধীরে ধীরে সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। ৪৮ বছর বয়সী মুহিবুল্লাহকে রোহিঙ্গারা ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ বলে ডাকত। মিয়ানমারে থাকতে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
মুহিবুল্লাহ গঠন করেছিলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)’ নামের একটি সংগঠন। যেটির চেয়ারম্যানও করা হয় তাকে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন তিনি।
জানা যায়, মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের আরকান মংডু এলাকার মৌলভী ফজল আহম্মদের ছেলে। ১৯৯২ সালে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন তিনি। এরপর থেকেই উখিয়ার ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় বসবাস করতেন। এক পর্যায়ে ১৫ জন সদস্য নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানরাইটস’ (এআরএসপিএইচ)। জনশ্রুতি রয়েছে এ সংগঠনের ব্যানারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছিলেন তিনি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সেই সময় বাস্তুচ্যুত অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন মুহিবুল্লাহ ও তার পরিবার।
রোহিঙ্গাদের বক্তব্য জানতে মুহিবুল্লাহর সংগঠন ‘এআরএসপিএইচ’ এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘ইউএনএইচসিআর’। ইংরেজি ভাষা এবং রোহিঙ্গাদের ব্যবহৃত ভাষা জানায় দুই পক্ষের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠেন তিনি। ধীরে ধীরে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন বিদেশিদের।
এদিকে গত ২০১৮ সালের পর জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যত বিদেশি প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের দেখা করানো হয়েছে। এই মুহিবুল্লাহই মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে মুহিবুল্লাহকে একাধিকবার আটক করে র্যাব। কিন্তু আবার প্রশাসনের নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
রোহিঙ্গাদের একটি সূত্রের দাবি, ক্যাম্পগুলোতে মুহিবুল্লাহ বিরোধী অন্য একটি সশস্ত্র গ্রুপও সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু মুহিবুল্লাহর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সুসম্পর্ক থাকায় আলোচনায় ছিল তার সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস। আর এ কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারাও মুহিবুল্লাহর ভক্ত ছিলেন।
জানা যায়, মুহিবুল্লাহ সবসময় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন দাবি করে এসেছেন। এ কারণে মিয়ানমার সরকারেরও কালো তালিকায় ছিলেন তিনি।
"বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-১ ইস্ট-ওয়েস্ট (ডি ব্লকে) নিজ অফিসে অবস্থান করছিলেন মুহিবুল্লাহ। এসময় বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।
সময় জার্নাল/ইএইচ