..........................
হালিম কাদা
অগ্রহায়ণ মাস। গ্রামের চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠে পাকা ধান যেন সোনার আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। মৃদুমন্দ বাতাসে পাকা ধানের ছড়া গুলো যেন হালকা তালে নাচছে। কাসেম ধান খেতের পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে পাকা ধানের নাচানাচি দেখছে। ও মনে মনে ঠিক করছে কোন খেতের ধান আগে আর কোনটা পরে কাটবে। প্রতি বছরের মত এ বছরও কার্তিক মাসে গরিব লোকদের বেশ খাওয়ার কষ্ট গেছে, তাই ধনী-গরিব সকলেই ধান কাঁটা শুরু হওয়ার জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
আজ মেহের নেগার শরীরটা বেশ খারাপ। কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। শরীরটাও বেশ ভারী লাগছে, পেটের বাচ্চাটা বেশ নড়াচড়া করছে। দুই মেয়ে দোতলায় বসে সেলাই করে, বই পড়ে আর গল্প করে। ছোট ছেলমেয়েরা স্কুলে গেছে। সবচেয়ে ছোট দুই ছেলে, হালিম আর মিনার মায়ের কাছাকাছি ঘুরঘুর করে। হালিমের বয়স প্রায় পাঁচ বছর আর মিনারের বয়স আড়াই বছর। এই দুইজন মায়ের আচল ধরা, খুব আদরের সন্তান। বাড়িতে চৌদ্দ/পরেরটা গৃহস্তের বাস। সব সময় মানুষের আনাগোনায় মুখরিত।
মেহের নেগার অবসন্ন শরীর কিছুটা বিশ্রাম চায়। কাজের মহিলাকে রান্নার আয়োজন করতে বলে সে গিয়ে পাকা মেঝের উপরে একটা শীতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। একটু পরে ঘুমে দুই চোখের পাতা আটকে আসতে চায়। টের পায় কেউ একজন পাশে দাঁড়িয়ে একটা তালের পাখা নিয়ে বাতাস করার চেস্টা করছে। বাতাসের চেয়ে গায়ে পাখার বাড়ি-ই বেশি লাগছে। ঘুম চোখে মেহের মেগা টের পেলো যে হালিম তাকে বাতাস করার চেস্টা করছে।
একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘তুই পাখাটা দিয়ে আমাকে আর পিটাইস না তে! যা, এখান থেকে'।
ছোট ছেলে মায়ের সেবা করার চেষ্টা করছিল, সেটা করতে না পেরে কি তার খুব অভিমান হলো? মা চলে যেতে বলেছে বলেই কি ভীষন অভিমানে চলে গেলো?
বেশ কিছুক্ষণ পরে মেহের নেগার চট করে ঘুম ভেঙে গেলো। ছেলেদের দেখতে না পেয়ে খোঁজ করল, একটু পরে মিনারকে পাওয়া গেলো উঠানে, একা একাই খেলছিলো। হালিমকে আর খুঁজে পাচ্ছে না। যাকেই জিজ্ঞেস করা হয় সেই বলে দেখেনি।
কাসেমকে একজন ডেকে নিয়ে এলো খেত থেকে। মেহের নেগা কাসেমকে বলল, 'স্কুলে গিয়ে দেখো তো, ভাইবোনদের দেখতে স্কুলে গেছে না কি'? কাছেই স্কুল, অনেক সময় স্কুলে চলে যায়। কাসেম এক ছুটে চলে গেলো স্কুলে আবার ফিরেও এলো অতি দ্রুত, না স্কুলে যায়নি। এবার সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। বাড়িতে অনেকগুলো পুকুর।
পাশের ঘরের আলতুর (আলতাফ হাওলাদার) মা দাদি বাড়িতে ঢোকার রাস্তার পাশে অবস্থিত তাঁদের কাছারি ঘর কাদা দিয়ে লেপতে ছিলেন। আলতুর মা বললেন যে উনি ঘর লেপার সময় ওরা দুই ভাই খেলতে খেলতে অল্প একটু সময়ের জন্য এখানে এসেছিলো।
এদিকে সবাই বারবার মিনারকে জিজ্ঞেস করছে, 'হালিম কই? সবার খোঁজাখুঁজি দেখে আর বারে বারে জিজ্ঞেস করাতে মিনার কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। তাই অনেকক্ষণ পরে সে আস্তে করে বলল, ‘হালিম কাদা‘।
দুয়ে দুয়ে চার হলো। দাদির কাদা দিয়ে ঘর লেপা আর ওই 'হালিম কাদা' শুনে সবার সন্দেহ এবার পুকুরের দিকে। ধরে নিলো ঘর লেপার ওখান থেকে পায়ে কাদা লাগিয়ে, সেই কাদা ধূতে দুই ভাই মিলে পুকুরে গেছে। মিনার হয়তো পুকুরে না নেমেই চলে এসেছে, আর হালিম ঘাটে পা পিছলে পুকুরে পড়ে গেছে।অতি দ্রুত জাল নিয়ে এসে পুকুরে ফেলা হলো। বাকিরা পুকুরের পাড়ে ঘুরে ঘুরে খুঁজতে থাকলো। অবশেষে কে একজন চেঁচিয়ে উঠলো, 'ওই তো'। সবাই দৌড়ে পুকুরের উত্তরপূর্ব কোনে গিয়ে দেখে, কয়েকদিন আগে ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া কিছু ডালপালার নিচে উপুড় হয়ে ভাসছে একটি শিশু। কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না, সে হালিম, নিষ্প্রাণ।
পটুয়াখালী শহর থেকে তিন মাইল পশ্চিমে পায়রা আর লোহালিয়া নদীর সংগমস্থলে ইটবাড়িয়া গ্রাম অবস্থিত। এই গ্রামের গাজী বাড়ির এক ছেলে এসে লজিং মাষ্টারকে বলল, 'স্যার, আমনেগো বাড়ি গোনে এক ব্যাডা আইচে'। মাস্টার স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, পাঞ্জাবিটা মাত্র গলা দিয়ে ঢুকিয়েছে। পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে, 'কে আসছে?' প্রশ্নটা শেষ করার আগেই তাকিয়ে দেখে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা, বগলে এক লম্বা ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে মোতাহার। মোতাহার মাস্টারের দূর সম্পর্কের চাচাত বোনের স্বামী। মাস্টার হঠাৎ করে মোতাহারের আগমনে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই বাড়িতে কোন অঘটন ঘটেছে।
উদ্বিগ্ন স্বরে মাস্টার জানতে চায়, 'কি খবর মোতাহারে, হঠাৎ তুমি? বাড়ির সব খবর ভালো তো'?
- হয়, খবর ভালো, তয় ভাউজের শরিলডা ভালো না। আমনেরে বাড়ি যাইতে কইছে ভাউজে।
- কি হইছে তার?
- কিছু না, খালি শরিল দুর্বল।
- কবিরাজ ডাকো নাই।
- আইছেলে, কি জানি ওষুধ দেছে। আমনে লন তড়াতড়ি।
মোতাহারের তাড়া দেখে মাস্টারের সন্দেহ হয়, বিষয় গুরুতর। ও কিছু লুকাচ্ছে। লজিং বাড়িতে বলে হেঁটেই রওয়ানা হয় দুজনে। নৌকা ডাকতে গেলে সময় লাগবে, আর নৌকায় যেতেও সময় বেশি লাগবে। নৌকায় নদী পার হয়ে মাটির রাস্তা ধরে হেঁটে এগোতে থাকে। মাস্টার একটু পরে পরে জানতে চায় মোতাহারের কাছে আসল খবর কি? সে একই উত্তর দিতে থাকে। মাস্টার মনে মনে ভাবে গিয়ে হয়তো তার স্ত্রীকে আর জীবিত পাবে না। বা হয়ত আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে গর্ভপাত হয়েছে, এখন নিজে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
মাস্টারের প্রশ্নবানে নাজেহাল হতে হতে মোতাহার অতি দ্রুত হেঁটে মাষ্টার থেকে একটা দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে। মাস্টার হাঁটার গতি বাড়ালেও মোতাহারকে ধরতে পারছে না। চারিদিকে কত গাছপালা, নাম জানা-না জানা পাখি, ফুল, ফল। একা একা এই পথে কতবার গেছে। পথ চলতে চলতে এসব দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগত, আজ আর কোন কিছুতেই মন নাই। বাড়ির কাছাকাছি রাস্তার দুইদিকে মাস্টারের সব ফসলি জমিতে ধানে পাক ধরেছে, আজ সেদিকে তাকিয়ে দেখারও সময় নাই। দ্রুত হেঁটে চলেছে বাড়ির দিকে।
এইভাবে হেঁটে হেঁটে কখন যে সাত মাইল পথ পার হয়ে বাড়ির প্রবেশমুখে মসজিদের কাছে চলে এসেছে ঠিক খেয়াল নাই। মসজিদ হাতের বাঁদিকে, তারপরেই একটা রাস্তা চলে গেছে উত্তরদিকে। রাস্তার পরেই পারিবারিক কবরস্থান। মসজিদের একটু আগে থেকেই মোতাহার হাঁটার গতি কমিয়ে মাস্টারের সাথে সাথে হাঁটছে।
কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে মাস্টার দেখে ছোট একটা নতুন কবর। মাস্টার ডুকরে কেঁদে উঠে মোতাহারকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'মোতাহার, আমার মিনার নাই'? কষ্টে তার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে, অতি আদরের ছোট ছেলে মিনার। মধুর স্বরে আব্বা ডাকে, নানা রকমের বায়না ধরে, আর আধো আধো বোলে কত যে কথা বলে! তার অতি আদরের ছোট ছেলে মিনারের ফর্সা গোলগাল মুখখানা চোখে ভাসে।
মোতাহার সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভাঙ্গায়, 'মিনার না ন্যাভাই, হালিম'।
মিনার না হয়ে হালিম হলে কি বাবার পুত্রশোক কমে? মাস্টার কাঁদতেই থাকে, কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। তার চোখে ভাসে শেষবার বাড়ি এসে যখন হালিমকে দেখেছিল, তখনকার চাহারা। রোগা, পাতলা একটু শ্যামলা, ডাগর চোখের লাজুক ছেলেটা। মিনার যেমন কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে, হালিম তা না। না ডাকলে কাছে আসে না, তার মায়ের সঙ্গই বেশি পছন্দ। মনে আছে আগেরবার যাওয়ার আগে, হালিম একটা বারাব্দার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, মাস্টার তাকে বলেছিল, 'তুমি আর কতদিন দরজার আড়ালে আড়ালে থাকবা, সামনের বৎসর স্কুলে ভর্তি করে দিবো'।
মাস্টার বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালে সাবই তাকে ঘিরে ধরে, কান্নার রোল পড়ে যায়। এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য রচিত হয়েছে মাস্টার বাড়ির উঠানে।
(আমার জন্মের আড়াই/তিন মাস আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনাটা মা আর বোনদের কাছ থেকে এতবার শুনেছি, মনে হয় সামহাউ আমি ওখানে উপস্থিত থেকে সব দেখেছি।)
লেখক পরিচিতি :
জেসমিন আরা বেগম,
কেমিকৌশলী, ১৩ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য এবং বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী।
প্রাক্তন উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, (বিপিএটিসি)।