দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে যে কয়জন নারী গুপ্তচর জীবন বাজী রেখেছিলেন তাদের মধ্যে নূর এনায়েত ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন স্পাই প্রিন্সেস (অর্থাৎ গুপ্তচরদের রানী)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলা গুপ্তচর হিসাবে কাজ করেছিলেন।
আজ আমি আমার "জানা অজানা" ধারাবাহিক লেখায় এ সাহসী নারীর সম্পর্কে জানাবো।
★ নুর একাধারে ছিলেন ভারতীয়, ফরাসী এবং ইংরেজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত বা ইংল্যান্ডের তুলনায় নূর ফ্রান্সেই বেশি পরিচিত। ফ্রান্সে তিনি পান বীরাঙ্গনার সম্মান। সে দেশে তাঁকে চেনে ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনের ‘মাদলিন’ হিসাবে। জার্মানরা তাকে শুধু ব্রিটিশ গুপ্তচর "নোরা বেকার" হিসেবে চিনত।
★ নূরের বাবা হযরত ইনায়েত খান ছিলেন একজন ভারতীয় সুফিবাদের শিক্ষক। তিনি ছিলেন বিখ্যাত সপ্তদশ শতাব্দীর ভারতীয় শাসক টিপু সুলতানের বংশধর ।
ইনায়েত খানকে উনার শিক্ষক সৈয়দ আবু হাশেম পশ্চিমে সুফি ধর্ম প্রচারের নির্দেশ দেন, যার জন্যে ভারত ছাড়েন ইনায়েত খান।
★ নূর ইনায়েত খানের মা আমেরিকান ছিলেন।
নাম পিরানি আমিনা বেগম। তিনি ছিলেন মার্কিন শিক্ষাবিদ পিয়ার বার্নার্ডের বোন।
★ নূর ১৯১৪ সালে রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ও ফ্রান্সে বেড়ে ওঠেন নূর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নূর ইনায়েতের পরিবার চলে আসে লন্ডনে। কিন্তু তারপর আবার ফ্রান্সে ফিরে যায়।
নূর বেড়ে ওঠেন ফ্রান্সে। সোরবর্নে শিশু মনোবিজ্ঞান এবং প্যারিস কনজারভেটরিতে সঙ্গীত শেখেন। পরবর্তীতে সুফিবাদ নিয়ে গবেষণাও করেছেন অসম সাহসী এই নারী।
★ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নূর ও তার ভাই বেলায়েত নাৎসিদের বিরুদ্ধে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন ফ্রান্স ছিল মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত।
★ শিশুদের জন্য গল্প ও ছড়া লিখতেন নূর ইনায়েত খান। তিনিই একসময় হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ এক গোয়েন্দা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী দখলকৃত ফ্রান্সে যুক্তরাজ্যের স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভের (এসওই) হয়ে কাজ করেন এই দুঃসাহসী নারী।
★ নূর যোগ দিয়েছিলেন "উইমেন’স অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্সে"।
প্রথমে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় অয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে।
নাৎসি অধ্যুষিত প্যারিসে যখন সব ওয়্যারলেস অপারেটররা একের পর এক গ্রেফতার হয়েছিলেন, তখন নূরই ছিলেন একমাত্র যিনি জার্মানদের সাথে মিশে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে লন্ডনের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। গুপ্তবার্তা প্রেরণ করেছেন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পার্টিতে তাকে হরহামেশাই দেখা যেত। আর প্রতি মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠাত লন্ডনে।
★ নূর ছিলেন খুবই নরম প্রকৃতির। তাই তার উচ্চপদস্থরা ধারণা করেছিলেন নূর গোয়েন্দা হিসেবে সফল হবেন না। কিন্তু তার কাজের দক্ষতা দেখে স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ (ফ্রান্স) শাখায় গুপ্তচর হিসেবে নূরকে পাঠানো হয়। সেখানে তার সাংকেতিক নাম ছিল ‘মেডেলিন’।
★ একজন ফরাসি ডাবল এজেন্টকে ব্যবহার করে তাকে এরেস্ট করা হয়। নুরের সার্কিট লিডার হেনরি গ্যারির বোন রিনি গ্যারি বিশ্বাসঘাতকতায় নূর ধরা পড়েন জার্মানির হাতে। ১৯৪৩ সালের অক্টোবরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকেও দু’বার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন নূর। তখন নূরের ওপর চলে অমানুষিক অত্যাচার। কিন্তু তিনি একটি তথ্যও ফাঁস করেননি।
★ কোমল নূর তখন এতটাই কঠোরভাবে সব মুখ বুজে সহ্য করেন যে নাৎসিরা তাকে ‘ভয়ংকর বিপজ্জনক’ নাম দিয়েছিল। হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে প্রচণ্ড অত্যাচার করা হতো তাকে। ★একসময় আরেক সঙ্গীসহ তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডাকাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ★১৯৪৪ সালে ডাশাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় মাত্র ৩০ বছর বয়সে।
মৃত্যুর আগে তাঁর বলা শেষ কথা ছিল ‘লিবের্তে’, অর্থাৎ স্বাধীনতা। এর পরপরই তার মৃতদেহ জ্বলন্ত শ্মশানে ফেলে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেছিলো তখন তার দেহ পুড়ার।
★ ১৯৪৯ সালে মরণোত্তর জর্জ ক্রস সম্মানে ভূষিত হন নূর। এটিই ব্রিটেনের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান। পৃথিবীতে মাত্র চার জন নারী এখন পর্যন্ত এই সম্মান দেওয়া হয়েছে।
★ প্যারিসের মেয়র তাকে "আধুনিক যুগের জোয়ান" এবং জেনারেল চার্লস ডি গলের ভাতিজি ম্যাডাম ডি গল অ্যান্থনিওজ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, প্যারিসে একটি স্মারক সেবায় তাকে শ্রদ্ধা জানান:
"কিছুই না, না তার জাতীয়তা, না তার পরিবারের ঐতিহ্য, এগুলির কেউই তাকে যুদ্ধে তার অবস্থান নিতে বাধ্য করেনি। যাইহোক, তিনি এটি বেছে নিয়েছেন। এটা আমাদের লড়াই যেটা সে বেছে নিয়েছে, যেটা সে প্রশংসনীয় এবং অদম্য সাহসের সাথে চালিয়েছে। ”
★ তাকে সম্মান জানাতে মধ্য লন্ডনে তাঁর বসতবাড়ির সামনে বসছে মর্যাদাপূর্ণ "ব্লু প্লেক"। স্মৃতি ফলকটি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে উদ্বোধন করবেন নূরের জীবনীকার শ্রাবণী বসু।
জীবনীকার শ্রাবণী বসুর বিবৃতিতে, ‘জীবনের শেষ অভিযানে যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়ার সময় নূর হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি, একদিন সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হবে। তিনি একজন অসাধারণ চর ছিলেন।’
★ ১৯৩৯ সালে তাঁর কুড়ি জাতক গল্পের বইটি বৌদ্ধ ঐতিহ্যের জাতক কাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লন্ডনে প্রকাশিত হয়েছিল।
নূরের জীবনি জানা ও নতুন প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। এ সাহসী নারীর প্রতি রইলো শ্রদ্ধা ও সন্মান ।
(তথ্য ও ছবি,, গুগলের সাহায্যে সম্পাদিত )
রুমানা মির্জা
লন্ডন। ইউ,কে