সৈয়দ জামান লিংকন :
জাপানের রাজনীতি নিয়ে আমাদের বেশীরভাগেরই কোন ধারনা নেই। রাজনৈতিক কাঠামোর দিক দিয়ে আর দশটা গনতান্ত্রিক দেশের সাথে জাপানের কোন পার্থক্য নেই। জাপানেও স্থানীয় নির্বাচনের (চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র) পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন (সংসদ) নির্দিষ্ট সময় পর পর হয়ে থাকে। কাঠামোগত পার্থক্য না থাকলেও ভোটার আর প্রার্থীর সম্পর্কটা আমাদের দেশের সাথে সম্পুর্ন ভিন্ন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের স্থানীয় নির্বাচন (ইউপি) হচ্ছে, যার উত্তাপ আমি ৬০০০ কিমি দুরে থেকেও ঠের পাচ্ছি, অথচ আমার বর্তমান বাসস্থানের স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন কবে হয়েছে এবং এর পর কবে হবে আমি জানি না। আমি যতদূর শুনেছি বাংলাদেশের একজন ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীকে দলীয় নমিনেশন পেতে কমপকমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকা দিতে হয়, কেউ কেউ আবার নমিনেশন কনফার্ম করার জন্য টাকার অংকটা আরো একটু বাড়িয়েই দেয়। ইউপি পর্যায়ে নমিনেশন পেতে ২০ লক্ষ হলে জাতীয় পর্যায়ে অংকটা কত হতে পারে, নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছেন। লক্ষ্মীপুরের একজন কাতারের ব্যবসায়ীর ঘটনায় জানা যায়, টাকার অংকটা কয়েক কোটি। এরপর নির্বাচনী খরচ ত আছেই। স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন সবগুলোই কিন্তু জনসেবামূলক কাজ, অর্থাৎ সবাই এত টাকা খরচ করছেন জনগনের সেবা করার জন্য।
জাপানেও অনেক প্রবাসী বাংলাদেশের মুল রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। রয়েছে প্রতিটি দলের রাজনৈতিক শাখা, রয়েছে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের মত লোভনীয় পদ। মজার ব্যাপার কি জানেন, এসব রাজনৈতিক সংগঠনের কমিটি বাংলাদেশের মুল দল থেকে অনুমোদিত হয়ে থাকে। উনারা কোন আইনের ভিত্তিতে বাংলাদেশে বসে জাপানে অভ্যন্তরে বাংলাদেশের কাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয় আমার জানা নেই। জাপানের সংবিধান অনুযায়ী জাপানে অভ্যন্তরে বৈদেশিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর কোন সুযোগ নেই। অর্থাৎ জাপানে অফিসিয়ালি অন্য দেশের রাজনীতি কমিটি ত দুরের কথা যে কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপও অবৈধ। শুধু জাপান নয়, ইউরোপ আমেরিকার জন্য এটা প্রযোজ্য।
বাংগালীর রক্তের শিরায় শিরায় রাজনীতি তাই বাংগালীদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। এক্ষেত্রে সমাধান হলো, প্রবাসে মুল রাজনীতির সাথে জড়ানো, সেক্ষেত্রে কাংখিত জনসেবা করার সুযোগও পাওয়া যাবে এবং পকেটের টাকা খরচ করতে হবে না নমিনেশন কিংবা কমিটির পদ কেনার জন্য।
এখন প্রশ্ন হলো জাপানের মুল রাজনীতিতে প্রবাসীদের সুযোগ কতটুকু? আপাতদৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও আমার ধারণা খুবই সম্ভব। বিশেষ করে জাপানের নতুন প্রজন্ম টিপিক্যাল জাপানীজ ধারনা থেকে বেরিয়ে আসছে। জাপানের জাতীয় রাজনীতিতে প্রবাসী জাপানিজরা আস্তে আস্তে সুযোগ করে নিচ্ছে। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জাপানীজরা একদিন জাপানের মুল রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেবে।
মুল জাপানীজরা প্রবাসীদের নেতৃত্ব মেনে নেয় কিনা সেটা জানার জন্য আমি ছোট্ট একটা পরীক্ষা করেছিলাম। আমার ছোট মেয়ে বেশ কিছুদিন আগে আমাকে জানাল তার স্কুলের Student Council (৭-১২ ক্লাস) এর নির্বাচন হবে এবং তার বন্ধুরা চাচ্ছে সে যেন নির্বাচন করে। আমি তাকে নির্বাচন করার অনুমতি দিলাম, আমার ধারনা ছিল বিদেশীদের ওরা ভোট দিবে না। আমার মেয়ের পোস্টে ৩ জন নির্বাচন করেছিল এবং নির্বাচনের ফলাফলে আমার মেয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আমার ধারণা পাল্টে দিল। এ নির্বাচন অবশ্য আমাদের দেশের স্কুল/কলেজের নির্বাচন থেকে ভিন্ন, মিছিল/মিটিং, পোস্টারিং নেই। প্রত্যেকেই নির্বাচনী ইশতেহার (পাশ করলে ছাত্র কল্যাণে কি করবে) স্কুলের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে ছিল এবং একদিন ওয়েভ মিটিংএ সকলের সামনে বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। এই ফলাফলে আমি বিশ্বাস করি জাপানীজরা, প্রবাসী জাপানীজদের মুল রাজনীতিতে মেনে নিবে।
রাজনৈতিক সচেতন প্রবাসী বাংলাদেশীরা জাপানের অবৈধ রাজনৈতিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে জাপানের মুল রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেদের বিলিয়ে দিবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক :
সৈয়দ জামান লিংকন :
প্রিন্সিপ্যাল সাইন্টিস্ট, মিতসুবিসি অ্যাকুয়া সল্যুসন্স, জাপান।
টোকিও, নভেম্বর ১৪, ২০২১