মালেকা আক্তার চৌধুরী: কোভিড-১৯ অণুজীবের দাপটে কিছুটা স্তিমিত হয়ে চিরায়ত চেনা পৃথিবী অচেনার মোড়কে পরিবর্তিত, স্বাভাবিকতায় আবার ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। জীবনে সমাজে রাষ্ট্রে পুরো বিশ্বে যেনো ছন্দে-সুরে কর্মচাঞ্চল্যে গতির আনন্দ বয়ে চলেছে। যদিও বিজ্ঞান প্রযুক্তির আশীর্বাদপুষ্ট পৃথিবী ক্ষুদ্র এই অণুজীবের কাছে নতজানু রুপেই ধরা পড়েছে। শুধু মৃত্যুই নয়! সমূলেই উৎপাটিত হয়েছে বিশ্বজনপদের আপন জ্ঞাতি-প্রিয়জন থেকে শুরু করে বহু জ্ঞানী গুণী মেধাবী সজ্জন। কালের যাত্রাপথ কখনও থেমে থাকেনি তবে থমকেছে, চমকে আবার জাগরিত হয়েছে। আজকের সকালের হেমন্তের নরম কোমল মিষ্টি রোদের ঝিলিকে অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়েছে।
আজ "বিশ্ব দর্শন দিবস"। ইউনেস্কো ঘোষিত এ দিবসটি প্রতি বছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পালিত হয়। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ তাই মুখরিত কলকাকলিতে ভরপুর, দর্শনের শিক্ষক শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য দর্শনানুরাগীদের পদচারণায়। সূর্যের বিকীর্ণ আলো যেনো কলাভবনের শতবর্ষী বৃক্ষরাজির ফাঁক ফোকর গলে ঠিকরে পড়ে আলোছায়ায় ঘেরা অপূর্ব এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি করেছে। চিরচেনা ক্যাম্পাসের এই স্মৃতি আকীর্ণ জায়গাগুলি তাই সবসময়ই আমাকে টানে। অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের উদ্যোগে র্যালিতে অংশগ্রহণসহ টিএসসি তে দিবসটি কেন্দ্র করে আলোচনায় অংশ নেবেন বলে। যদিও অপরাজেয় বাংলা সংস্কারের জন্য আবৃত রয়েছে, তাতে কী! ওই জায়গার আবেদন তো ব্যাকুলভাবে রয়েছে সকলের প্রাণে-প্রাণে। তাই বিচিত্ররুপে চললো ফটোশুট। আমার বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর নাছিমা আক্তার চৌধুরীসহ বিভাগ থেকে আগত সহকর্মী ছোটো বোনদের মধ্যে এথিনা, জেসমিন শাপলা ; ওদিকে ইডেন কলেজের শামীমা আপাসহ অন্যান্য সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ। দীর্ঘ করোনা বিরতির পর এ যেনো হঠাৎ জমে ওঠা এক আনন্দঘন মিলনমেলা। এসেছেন ঢাকা কলেজসহ অন্যান্য কলেজের ছাত্র শিক্ষকবৃন্দ।
র্যালিতে অংশগ্রহণ করতে না করতেই মনে হলো টিএসসি তে পৌঁছে গেলাম। যথাসময়ে উপস্থিত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য এবং আজকের আলোচনা সভার সম্মানিত প্রধান অতিথি প্রফেসর ড.আখতারুজ্জামান স্যার। বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেছেন কলা অনুষদের সম্মানিত ডিন অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন। দর্শন বিভাগের সম্মানিত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হারুন রশীদ স্যারের সভাপতিত্বে -- " সমকালীন সংকট মোকাবেলায় দর্শন" শিরোনামে মূল বক্তা হিসেবে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন। অধ্যাপক ড. শাহ কাওছার মোস্তাফা আবুলউলায়ী স্যারসহ উপবিষ্ট ছিলেন স্মরণিকা কমিটির সম্পাদক আবুল খায়ের মোঃ ইউনুস স্যার।
অধিভুক্ত সাত কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নাছিমা আক্তার চৌধুরী এবং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহফুজা রহমান চৌধুরী বাবলি।
দর্শন সকল মত পথের উর্ধ্বে উঠে মানুষের মর্যাদা এবং বৈচিত্র্যকে সমর্থন করে। জ্ঞানের পাদপ্রদীপ প্রজ্জ্বলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দর্শন। একমাত্র দর্শনেই মানুষকে বিপুল সম্ভাবনার আধার মনে করা হয়। তাই তো অস্তিত্ববাদীরা স্বাধীন মানুষের মর্যাদাকে সংহত করেছেন অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই। জগতের বিস্ময়বোধ থেকে যে দর্শনের জন্ম সেটি আজ সময়ের পরিক্রমায় সত্যম শিবম সুন্দরমের আলোকে মহীরুহে পরিণত হয়েছে বটে কিন্ত প্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যক্তিগত লাভ লোভের কবলে পড়ে মানুষ দর্শন চর্চা থেকে দূরে ছিটকে পড়েছে। তাই তো পৃথিবীতে অন্যায় -অবিচার, শোষণ -পীড়ন, সাম্প্রদায়িকতার মতো অপশক্তি সমাজে শেকড় গেড়ে সমাজের সিঁধ কেটে সর্বনাশ করে চলেছে। পরাশক্তিদের পারস্পরিক শক্তিমত্তার অশুভ প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের কদর্য মনোবৃত্তি, অসহযোগিতা, অসহিষ্ণুতার দাপাদাপিতে বিশ্ব এক অস্হির গ্রহে পরিণত হয়েছে। তবে, মঙ্গলালোকের প্রত্যাশা অব্যাহত রেখেই দর্শন চর্চার পথকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে।
আলোচনা সভায় বক্তারা সকলেই দর্শনের মূল্যবোধের আলোকে, নৈতিকতার স্বার্থে প্রগতি ও মানকল্যাণের আহ্বান জানিয়েছেন। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সময়োপযোগী বক্তব্য ও মূল প্রবন্ধের গুরুত্ব অনুধাবনে অডিয়েন্স যথেষ্ট ঋদ্ধ হয়েছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। সভায় কোভিডকালীন সময়ে আমরা হারিয়েছি আমাদের শ্রদ্ধেয় সম্মানিত চারজন শিক্ষককে। তাদের একজন প্রথিতযশা কথাশিল্পী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক স্যার ; অন্য তিন দার্শনিক পণ্ডিত হলেনঃ অধ্যাপক হাছনা বেগম, অধ্যাপক ড. আব্দুল মতিন এবং অধ্যাপক ড.গালিব আহসান খান। আমরা তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক: অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী, দর্শন বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ।