মাহমুদুল হাসান, কুবি প্রতিনিধি:
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজেরা সুযোগ নিতে না পারায় প্রকল্পটি নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি, একটি চক্র গণমাধ্যম ও ফেসবুকে বেশ কিছু মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে প্রকল্পটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে বলে দাবি করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে উঠার পর এখন কাজ শুরু হবে এমন সময় এক পক্ষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে প্রকল্প নষ্ট করার জন্য।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ১৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার মেগা প্রকল্পের অনুমোদন পায় এবং ২০২১ সালের ১১ মার্চ প্রকল্প বাস্তবায়নে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ব্যাটালিয়ন ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৮.৮৯০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের নিকট গত বছরের ২৪ মে ৪ শত ৭১ কোটি ১১ লক্ষ ২২ হাজার ৫৫ টাকার চেক হস্তান্তর করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি, ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতিসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে গণমাধ্যম ও ফেসবুকে বিভিন্ন তথ্য প্রচরিত হলে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু, বাস্তবে এর সাথে তেমন একটা মিল নেই এবং নিউজগুলো করা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বলে দাবি অনেকের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক সানোয়ার আলী বলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদটিতে কিছু তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর বর্তমান ক্যাম্পাস ও নতুন ক্যাম্পাসের যে দূরত্ব দেখানো হয়েছে তা সঠিক নয়। দূরত্ব এর চেয়ে অনেক কম। আর বর্তমান ক্যাম্পাস ও নতুন ক্যাম্পাসের একটা সংযোগ সড়ক হওয়ার কথা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজে টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজেরা সক্রিয় থাকে। কিন্তু সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়ায় তাদের সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে তারা ফেসবুকে গুজব ছড়াতে শুরু করে এবং দুই-একটি মিডিয়াকে ব্যবহার করে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হোক। সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়ায় দ্রুত এবং সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে।
মূল ক্যাম্পাস থেকে দূরত্ব: টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজদের চক্রগুলো সম্প্রতি ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে অধিকতর প্রকল্পের জন্য ক্যাম্পাস থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রাজারখোলা গ্রামে জায়গা অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। তারা মিডিয়াকে ব্যবহার করে এ বিষয়ে দুইটি সংবাদও প্রকাশ করায়।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সানোয়ার আলী বলেন, পুরো প্রকল্পের জায়গা জরিপ এবং মাটি পরীক্ষা করে সেনাবাহিনী একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছে। ২০০ একর জুড়ে বিল্ডিং করতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। এই প্রকল্পের জমি সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে। যেখানে পাহাড় আছে পাহাড় থাকবে। যেখানে সমতল জায়গা সেখানে বিল্ডিং হবে। সবকিছু সেনাবাহিনী সাজানো গুছানোভাবেই করবে।
এছাড়াও তিনি বলেন, পরিবেশ ও প্রতিবেশের কোনো ধরনের কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, সেভাবেই পরিকল্পনা করে প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে। আমরা তো পরিবেশ অধিদপ্তরেরও ছাড়পত্র নিয়েছি। সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়া হয়েছে অল্প কয়েকদিনের ভিতরে কাজ শুরু হবে এখন একটা পক্ষ দুর্নীতি করতে পারবে না বলেই এসব গুজব এবং মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
শিক্ষকদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যাচার: অধিগ্রহনের জন্য নির্ধারিত জামমুড়া গ্রামের নতুন ক্যাম্পাস সংলগ্ন অনেক আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা জায়গা কিনে রেখেছেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে জায়গা রয়েছে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. শামীমুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের আবুল হায়াত, একই বিভাগের ফিরোজ আহমেদ, প্রত্নত্তত্ব বিভাগের সাদেকুজ্জামান তনু, বাংলা বিভাগের মোকাদ্দেস উল ইসলাম বিদ্যুৎ, অর্থনীতি বিভাগের নাসির হুসেইন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক কাজী ওমর সিদ্দিকী, একই বিভাগের সাহেদুর রহমান।
এছাড়াও, রসায়ন বিভাগের মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, গণিত বিভাগের জিল্লুর রহমান, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের জসিম উদ্দিন, মার্কেটিং বিভাগের জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, লোক প্রশাসন বিভাগের নাহিদুর রহমান ছাড়াও আরও অনেক শিক্ষক কর্মকর্তার নিজের নামে বা পরিবারের কারো নামে জমি রয়েছে। এদের কারও জায়গা অধিগ্রহণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় পড়েছে, কারো কারোটি পড়েনি। এ ছাড়াও বর্তমান ক্যাম্পাস সংলগ্ন স্থানে জায়গা রয়েছে, লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক মো. রশিদুল ইসলাম শেখ, পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক দুলাল চন্দ্র নন্দী এবং একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক বিশ্বজিৎ চন্দ্র দেবসহ আরো অনেকের।
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামিমুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রকল্পের ভেতর আমার কোন জায়গা নেই। এই নতুন প্রকল্প পাস হওয়ার আগে আমি জায়গা কিনেছিলাম যা পরবর্তীতে প্রকল্পের আশেপাশে পড়ে।
এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, কুমিল্লার গর্ব মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল), উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে মিথ্যাচার ও গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। আমিসহ আরও কয়েকজন জমি অধিগ্রহণের প্রায় দুই বছর আগে বাড়ি করার জন্য জামমুড়া গ্রামে জায়গা কিনি। কিন্তু আমাদের জায়গা অধিগ্রহনের জন্য নির্ধারিত জায়গার মধ্যে পড়ে যায়। এখানে আমাদের অপরাধটি কোথায়? কিন্তু একটি চক্র দুই-একটি মিডিয়াকে ব্যবহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করেন শুধুমাত্র এমন একটি পক্ষের শিক্ষকদের নিয়ে বারবার মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে।
এ প্রসঙ্গে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আবুল হায়াত বলেন, প্রকল্পের ভিতরে নয় আমার জায়গা রয়েছে প্রকল্পের বাহিরে। আর আমরা প্রকল্পকে কেন্দ্র করে জায়গা কিনি নি।
প্রকাশিত সংবাদে অধিগ্রহণ সংল্লিষ্টদের বক্তব্য নেই: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পটি গ্রহণের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী। কিন্তু প্রকাশিত সংবাদগুলোর কোথাও তাঁর বক্তব্য নেই। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. আবু তাহের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল কাজেই তদারকি করেছেন। কিন্তু প্রকাশিত সংবাদগুলোর কোথাও তাঁরও বক্তব্য নেই।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, সেনাবাহিনীকে কাজ দেয়ায় টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক টেন্ডারবাজ মুখিয়ে ছিল প্রকল্প ঘিরে, কিন্তু সে পথ বন্ধ থাকায় তারা প্রকল্পটা নষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। এ প্রকল্প যদি বাদ যায় তাহলে পুনরায় নতুন করে প্রকল্প আনা এতো সহজ না।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদর দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম সারওয়ার বলেন, একটি মহল বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নস্যাৎ এবং প্রকল্প থেকে অর্থ লুটপাট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করছে। আমি শীঘ্রই সংবাদ সম্মেলন করে প্রকৃত তথ্য জনসম্মুখে তুলে ধরবো।
সময় জার্নাল/ইএইচ