সর্বশেষ সংবাদ
ডা. জয়নাল আবেদীন :
করোনার বিস্তার রোধে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও নির্দেশনা অনেকটা পরনের লুঙ্গী মাথায় বেঁধে নেয়া লোকটার মতো।
ঐ যে এক লোক আচমকা ঝড়ের সামনে পড়ে গেল। ঝড় থেকে বাঁচার জন্য কী করণীয় সেটা কিছুতেই মাথায় আসছিল না লোকটার। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করল সে আসলে একটা গোবেট, অথর্ব ও মূর্খ; বিপদের মুহুর্তে কী করা উচিত একেবারেই জানা নেই তার। কিন্তু ব্যাপারটা মেনে নিতে মন সায় দিল না। বিড়বিড় করে বলল "কিছু একটা করতে হবে, কিছু একটা করতে হবে।"
সহসাই মনে পড়ল, আচ্ছা এই ঝড়ে যদি আমার চুল উড়ে যায়? চুল উড়ে গেলে তো মস্ত বিপদ। তাহলে কী করণীয়? করণীয় হলো চুল বাঁচাতে লুঙ্গীটা খুলে মাথায় বেঁধে নিতে হবে। ঝড়ের মুখে পড়ে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে অন্তত একটা কিছু করা হয়েছে, নিজেকে করিৎকর্মা প্রমাণ করা গেছে; এই ভেবে গর্ববোধ করেছিল লোকটা।
বলাই বাহুল্য চুল উড়ে যাবার আগে উড়ে গিয়েছিল লুঙ্গী। ঝড়ের শেষে লোকটা আবিষ্কার করেছিল, মোটা মাথার বুদ্ধিতে সে ক্ষতি তো এড়াতেই পারেনি; মাঝখান দিয়ে দিগম্বর হয়ে ইজ্জতটুকু খুইয়েছে।
আমাদের করোনা প্রস্তুতি লুঙ্গী খুলে মাথার চুল বাঁচানোর চেয়ে আলাদা কিছু না। বইমেলার সময় সাড়ে তিন ঘন্টা করা হয়েছে, গণপরিবহনের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ করে যাত্রী অর্ধেক করা হয়েছে, মোটর রাইড শেয়ারিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভাবছেন, বিশাল বড়ো কিছু করে ফেলেছি!
একটা হ্যান্ডমাইক হাতে নিয়ে উনাদের কানের কাছে গিয়ে আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আপনারা হিন্দি চুল করেছেন।
সিম্পল কিছু অঙ্ক হিসেব করি।
ধরুন ফার্মগেট থেকে গুলিস্তানে প্রতিদিন দশ হাজার মানুষ যাওয়া আসা করে। করোনায় যেহেতু কিছুই বন্ধ নেই, (বন্ধ হবেই বা কীভাবে? বন্ধ হবেই বা কেন? মানুষের বাঁচতে তো হবে) তার মানে প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে সেই দশ হাজার মানুষেরই যাতায়াত করা লাগবে।
হুট করে যাত্রী অর্ধেক করে দেয়ার ফলে কী হবে, বাসগুলো তাদের সক্ষমতার অর্ধেক লোক নেবে। দ্বিগুণ সিটে লোক বসিয়ে, আরো একগুণ দাড় করিয়ে রাখার পরেও ঢাকার বাসে ওঠা যায় না, জ্যাম লেগেই থাকে। এখন অর্ধেক লোক করার মানে হলো হিসেবমতে আপনাকে বাস দ্বিগুণ করতে হবে এবং একই সাথে রাস্তা দ্বিগুণ চওড়া করা লাগবে যদি জীবন স্বাভাবিক রাখতে হয়। (ঢাকার জীবন এমনিই কি স্বাভাবিক?)
বাস দ্বিগুণ বা রাস্তা চওড়া করা সম্ভব?
যেহেতু সম্ভব না তার মানে বাকি অর্ধেক লোক মারামারি করে হলেও বাসে উঠবে। ভাঙবে তথাকথিত স্বাস্থ্যবিধি নীতি। আর যদি বাসে উঠতে না পারে তবে হাজার খানেক লোক ফার্মগেট গিজগিজ করবে, এক হাজার দাঁড়াবে কারওয়ান বাজারে, শাহবাগে দুই হাজার, মৎসভবনে এক হাজার...
এই যে শরীরে শরীর লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে মানুষ, এখান থেকে করোনা ছড়াবে না? একটা বাসে লোক অর্ধেক করে হয়তো ৩০-৪০ জনের ভিড় কমানো গেল, কিন্তু রাস্তায় যে হাজারখানেক লোক গোল হয়ে দাঁড়াবে...বাস আসলে হইহই করে ছুটবে, বাসের দরজার সামনে শখানেক লোক মোয়ার মুড়ির মতো মিশে হ্যান্ডেল ধরার চেষ্টা করবে, নাকে নাক ঘষাঘষি হবে; এর থেকে করোনা ছড়াবে না? নাকি করোনা কেবল বাসের ভেতরে থাকে, রাস্তায় থাকে না?
উবার-পাঠাও বন্ধ করলেন৷ বাস এড়িয়ে অন্যভাবে চলার পথও বন্ধ। তাহলে মানুষ কী করবে?
ভাই এই হিসেবটা কি খুব জটিল বা কঠিন কিছু? এটা বুঝতে আইন্সটাইন হওয়া লাগে?
মানুষের কষ্টের কথা নাই বা বললাম। মানুষের কষ্ট উনারা ভাবলে তো হইছিলই! এই দুর্দিনে ও দুর্মূল্যের বাজারে মানুষ ডাবল ভাড়া গুনছে, এইটা অবিচার হচ্ছে না? করোনার চেয়ে এই কষ্ট তো বেশি হয়ে যাচ্ছে।
উবার পাঠাও যারা চালায় তারা কেউ কোটিপতি হবার জন্য রাইড দেয় না। বেশিরভাগই টিকে থাকার জন্যই মানুষকে বাইকে বসিয়ে ট্রিপ দিচ্ছে। অনেকের পরিবার এই ইনকামের উপর নির্ভরশীল। কেউ কেউ বাইক কিনেছে লোন দিয়ে, রাইডের টাকায় কিস্তি দিতে হয়।
মাত্র দুইজন মানুষ পাশাপাশি বসবে, তাতে করোনা সংক্রমণের আশংকা থেকে রাইড শেয়ারিং বন্ধ করে দেয়ার আগে এদের অবস্থার কথা ভাবলেন না? এদের ব্যাকআপ কী জানা আছে?
দুইজন পাশাপাশি বসা বন্ধ করতে যেদিন রাইড শেয়ারিং অফ করা হলো ঠিক সেদিন বরিশালে সাড়ে নয় হাজার মানুষ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মুজিব বর্ষের লগো ফ্রেম বানিয়েছে।
হোয়াট ওয়াজ দ্যাট! এই দ্বিচারিতার মানে কী? ঠিক কোথায় করোনা ছড়াবে আর কোথায় ছড়াবে না এটাও আপনাদের ঠিক করে দেয়া?
করোনা প্রস্তুতিতে সবচেয়ে হাস্যকর এবং বালখিল্য পদক্ষেপ হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার টাইপ জায়গায় সময় সংকোচন করে দেয়া।
একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারে যদি ১৫ ঘন্টায় ১০ হাজার মানুষ যাওয়া আসা করে, সময় ৩ ঘন্টা বেঁধে দিলে সেই দশ হাজার মানুষই যাওয়া আসা করবে। ১৫ ঘন্টার চাপ পড়বে ৩ ঘন্টায়, লোক সমাগম বাড়বে ৫ গুণ। লোকসমাগম ৫ গুণ বেড়ে যাওয়া মানে করোনার ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেড়ে যাওয়া।
এই পানির মতো সহজ হিসেব কেন উনাদের মাথায় ঢুকে না? এমপি থ্রি আর রাজনৈতিক তোষামোদ এতটাই মগজ খেয়ে ফেলেছে যে এইটুকু ভাবা যায় না?
বইমেলার সময় সংকোচিত করে সাড়ে তিন ঘন্টা করা হলো। ঢাকা শহরের মানুষ তিন ঘন্টা সময় টার্গেট করে মেলায় আসতে পারবে, তাও যানবাহনের এই দুর্যোগের সময়ে!
মেলার ক্ষেত্রে করণীয় ছিল দুইটা। একেবারে বন্ধ করে দেয়া নয়তো সময় আগের চেয়ে বাড়িয়ে দেয়া। তারচেয়ে জরুরি ছিল স্বাস্থ্যবিধির প্রতি জোর দেয়া। আমি এক দিনের জন্য মেলায় গিয়ে স্বাস্থ্য বিধির বালাই দেখেনি। ৮০% লোকই মাস্ক পরে না। লেখকরা মাস্ক খুলে দাঁত কেলিয়ে ছবি তোলে।
মাস্ক না পরলে মেলায় ঢোকা যাবে না, মাস্ক খুললে জরিমানা এবং যে লেখক মাস্ক খুলে ছবি তুলবে তাকে মেলা থেকে বহিষ্কার...এইটুক ফলো করে মেলা দিব্যি চালিয়ে নেয়া যেত। প্রকাশনীগুলো এবার স্টলের খরচের টাকা তুলতে পারবে না। সাড়ে তিন ঘন্টার প্রহসনে মেলা বন্ধ হবার আগে অনেক প্রকাশনী বন্ধ হয়ে যাবে। সৃজনশীল প্রকাশনা বন্ধ হলে মূর্খ জাতি আরো মূর্খ হবে। এটা অন্য আলোচনা, এখন থাক।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছিলাম। এবার লিখছি না, ফেসবুকের নিউজফিডও দেখি না। নিউজফিড দেখলে প্রচুর বলদামি দেখতে হতো। মেজাজ ঠিক রাখা যেত না।
একটা লক ডাউনের প্রভাব দেশে এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বছর পার হতেই দারিদ্রের হার ১৯% থেকে এক লাফে ৪২% এ চলে গেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিলুপ্ত হয়ে নিম্নবিত্তের দিকে চলে যাচ্ছে, আর কিছুদিন পর পোশাকি ভদ্রতা ভুলে তাদেরকেও ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো লাগতে পারে।
এই সময়ে প্লিজ, আরেকটা লক ডাউন জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েন না। প্রথম লক ডাউনের যতটা পক্ষে ছিল, এবার ঠিক ততটাই বিপক্ষে। লক ডাউন গরীবকে আরো গরীব করেছে, মধ্যবিত্তকে গরীবের সারিতে এনেছে; কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
হাসপাতালে একটা সিট বাড়েনি, একটা আইসিইউ শয্যা বাড়েনি, সেকেন্ড ওয়েভ ফেইস করার জন্য চিকিৎসকদের জন্য আলাদা কোনো ট্রেনিং বা সুবিধা দেয়া হয়নি, প্রনোদনার দানা আসেনি গরীবের দরজা পর্যন্ত।
(প্রসঙ্গত, করোনা ইস্যুতে দ্রুত ভ্যাক্সিন নিয়ে আসা বিশাল একটা অর্জন, সম্ভবত একমাত্র। এই উদ্যোগে যারা ছিলেন তারা ধন্যবাদ ডিজার্ভ করেন।)
বাস-লঞ্চের ভাড়া দ্বিগুণ করে একটা বাঁশ দেয়া হয়ে গেছে। জান্নাতি মাস রমজান আসলেই জিনিসপত্রের দাম কোনো আচানক ম্যাজিকে বেড়ে যায়, এটাও গরীবের জন্য আরেক অভিশাপ।
লক ডাউন দিলে আগের মতোই চেয়ারম্যানের খাটের তলা থেকে তেলের গোদাম বের হবে, প্রনোদনার লোভে আবারও গার্মেন্টস শ্রমিকদের হাঁটিয়ে ঢাকায় এনে তারপর ফেরত পাঠানো হবে। সর্বোপরি জনতা আগের মতোই স্বাস্থ্যবিধি মানবে না। ধনীকে ধনী বানানো এবং দারিদ্রের গ্রাফ উর্ধ্বাকাশে নেয়া ছাড়া লক ডাউনের আর কোনো প্রভাব থাকবে বলে মনে হয় না।
যদি কিছু করতেই হয়, জনগণকে স্বাভাবিক জীবনেই থাকতে দিন। মাস্কের ব্যাপারে কঠোর হোন।(মাস্ক পরানো ছাড়া আসলে আর কী করার আছে)
হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো হোক, আইসিইউ বাড়ুক। ডাক্তারদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে তাদের প্রাপ্য প্রনোদনার টাকা দিয়ে দিন। স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত যে কোনো কমিটিতে প্রশাসন মাড়ানো কর্মকর্তা ছাড়াও এক দুজন ডাক্তার রাখুন।
সবচেয়ে বড়ো কথা, কিছু বলার বা করার আগে গাড়ির এসিটা বন্ধ করে গ্লাস নামিয়ে মানুষের দিকে একবারের জন্য দেখুন। তাদের চোখ-মুখ বা ঘর্মাক্ত শরীর কী বলে বোঝার চেষ্টা করুন। থিওরিটিক্যাল সিদ্ধান্ত নেবার আগে প্রাক্টিক্যাল পরিস্থিতি দেখুন।
করোনা আগের চেয়ে তীব্রভাবে এসেছে। তবে যেহেতু করোনার প্রকোপ ব্যাপারে এতদিনে ধারণা হয়ে গেছে, এটা মোকাবেলা করা আগের চেয়ে সহজ হবার কথা।
কিন্তু আমি জানি, আপনিও জানেন...কিছুই করা যাবে না।
যদি মনে করেন- ঝড়ের মুখে কী করতে হবে এমপিথ্রি ব্রেইনে তা ধরে না, প্লিজ চুপচাপ থাকুন। বুদ্ধি করে চুল বাঁচানোর জন্য লুঙ্গী মাথায় বেঁধে নেয়ার দরকার নেই। মূর্খের কোনো কিছু না করাই সবচেয়ে বেশি করা হয়।
ধন্যবাদ।
Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.
উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ
কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল