সৈয়দ জামান লিংকন (পানি গবেষক, টোকিও জাপান) :
উন্নত বিশ্বে লাইফ লাইন বলতে বিদ্যুৎ এবং খাবার পানি সরবরাহের বুঝানো হয় এবং কোন শহর প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হলে সবার আগে খোঁজ নেয়া লাইফ লাইন ঠিক আছে কিনা, যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে লাইফ লাইন পুনসংযোগ করা। কারন লাইফ লাইন বিচ্ছিন্ন মানেই হচ্ছে শহরটি মৃত।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরে ডায়রিয়া সহ পানি বাহিত বিভিন্ন রকম রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জনসচেতনতার জন্য কয়েকদিন আগে ঢাকার পানি নিয়ে একটি ছোটখাট আর্টিকেল লিখলেও আজ ঢাকার পানির বর্তমান পরিস্থিতি, দুষনের কারন এবং করনীয় নিয়ে বিস্তারিত লিখতে চাচ্ছি।
ঢাকা শহরের সরবরাহকৃত পানির প্রধান উৎস (প্রায় ৭০-৮০%) হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি বাকীটা সংগ্রহ করা হয় ঢাকা শহরের আশপাশের নদী থেকে। ঢাকা শহরের নীচে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ কতটুকু এবং প্রতিবছর কতটুকু পানি উত্তোলন করা হচ্ছে এবং কত বছর পর্যন্ত উত্তোলন করা যাবে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান আমার চোখে পড়েনি। সাধারনত বৃষ্টির পানি মাটি ভেদ করে ভূগর্ভে জমা হয়, তবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনে ঢাকা শহরে বৃষ্টির পরিমান অনেক কমে গেছে পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ স্থাপনা বৃদ্ধি এবং নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর পড়ে ভূগর্ভে পানি প্রবেশের পথ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে হুহু করে এবং অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলনের পরিমান, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ কমছে আশংকাজনক ভাবে এবং এটা ঢাকা শহরের জন্য একটা বিরাট হুমকি।
ভূগর্ভস্থ পানিকে সৃষ্টিকর্তার নিয়ামত বা আশীর্বাদ বলা হয়, কেননা এই পানি প্রাকৃতিক উপায়ে পরিশোধিত এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কোনোরকম পরিশোধন ছাড়াই পান করার যোগ্য। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের কারনে ভুগর্ভস্থ পানিও দুষিত হচ্ছে। আমার জানামতে এই মুহুর্তে ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানি কোন রকম পরিশোধন ছাড়াই সরবরাহ করা হলেও ভবিষ্যতে সেটা সম্ভব হবে না।
যেহেতু ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ কমে যাচ্ছে তাই সরকার চেষ্টা করছে নদীর পানির পরিশোধন বাড়িয়ে চাহিদা মেটাতে। ঢাকা শহরের আশেপাশের নদীগুলোর পানির দুষনের পরিমাণ ভয়াবহ এবং দিনদিন পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। একদিকে কম বৃষ্টি অন্যদিকে কল কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যের কারনে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান শুন্যে নেমে এসেছে, মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ছে এমোনিয়া সহ বিষাক্ত দ্রবীভূত রাসায়নিক পদার্থ। নদীর পানির যে স্ট্যান্ডার্ড ধরে পানি পরিশোধনের প্রসেস ফ্লো তৈরি করা হয়েছিল সেটা এখন ভেংগে পড়েছে যারফলে পরিশোধিত পানিতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বাড়ছে দিনকে দিন।
ভুগর্ভস্থ পানি এবং নদীর পরিশোধিত পানি মিক্সড করে সরবরাহ করাতে পুরু সরবরাহ পানি দুষিত হয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি অতি পুরাতন সরবরাহ লাইনের বিভিন্ন জায়গায় লিকেজের কারনে দুষনের মাত্রা আরো বাড়ছে। এমনও শুনা যায় সুয়ারেজ লাইন আর পানি সরবরাহ লাইন পাশাপাশি প্রবাহিত হয়ে লিকেজের কারনে একে অপরের সাথে মিশে দুষিত হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে ঢাকার মানুষ।
একদিকে ভুগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ কমে যাওয়া অন্যদিকে নদীর পানির দুষন বাড়তে থাকায় ঢাকাকে বাঁচাতে দরকার সঠিক স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা আর সেটা করতে ব্যর্থ হলে ঢাকাকে মৃত ঘোষণা করতে খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনাঃ
যেহেতু পুরু সরবরাহ লাইন দুষিত তাই চাইলেই দ্রুত বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ করা সম্ভব নয়। আপাতত সরবরাহকৃত পানিতে ক্লোরিনের পরিমান কন্ট্রোল করতে পারলেই পানিবাহিত বেশীরভাগ রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব। সরবরাহ লাইনে ক্লোরিনের পরিমান বাড়িয়ে কোন লাভ হবে না, যেমন টা সেদিন বললেন ওয়াসার এমডি। পানিতে ক্লোরিনের মাত্রা ০.৩-১ মিলিগ্রাম/লিটার রাখতে হয় এর কমবেশী দুটোই ভয়াবহ ক্ষতিকর। ক্লোরিন এর পরিমান কন্ট্রোল করার জন্য সরকার সারা ঢাকাকে খুব ছোট ছোট এলাকায় ভাগ করে এলাকা ভিত্তিক ক্লোরিন ডজিং পাম্প বসাতে পারে এবং প্রতিটি এলাকার পানি আলাদাভাবে এনালাইসিস করে প্রয়োজনীয় ক্লোরিন মিশাতে পারে যাতে বাসা বাড়ির ট্যাপে প্রয়োজনীয় মাত্রার ক্লোরিন বিদ্যমান থাকে। যদি ক্লোরিন কনজিউমকারী এমোনিয়া সহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ কন্ট্রোলে না থাকে সেক্ষেত্রে Pre/Post ক্লোরিন ডোজিং এ যেতে হবে। পানিতে ক্লোরিন এর মাত্রা ঠিক রাখতে পারলেই বাঁচা যাবে পানিবাহিত বেশীর রোগবালাই থেকে।
দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনাঃ
১. যে সকল নদীর পানি পরিশোধন করা হয় সেগুলোর দুষন রোধের বিকল্প নেই। কল কারখানা যেহেতু বন্ধ করা সম্ভব নয় তাই সেসবের বর্জ্য শোধনের জন্য বাস্তব ভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করতে হবে ব্যবস্থা, বাড়াতে হবে প্রয়োজনীয় সরকারী ভর্তুকির ব্যবস্থা, অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব গুলোকে যাতে প্রয়োজনীয় গবেষণা করে সরকারের করনীয় নির্ধারণ করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়েসট ওয়াটারের স্ট্যান্ডার্ড বেশ কঠিন যা মেইনটেইন করা বেশ ব্যয়বহুল ফলে বেশীরভাগ কলকারখানা নাম মাত্র শোধনাগার বসিয়ে টাকা পয়সা দিয়ে রাতের অন্ধকারে বর্জ্য পরিশোধন না করে নদীতে ফেলছে।
২. বড় বড় নদী যেগুলোর পানি দুষন মুক্ত সেসব নদী থেকে খাল কনন করে ঢাকায় এনে পরিশোধন করা।
৩. বৃষ্টির পানি ভুগর্ভস্থ রিজার্ভে ঢুকার জন্য মুক্ত জায়গা বাড়ানো, খাল বিল নদী নালার তলদেশ পলিথিন মুক্ত করা। ভূগর্ভস্থ পানির জরিপ করে পানির প্রবাহ এবং পরিমাণ নির্ধারণ করে উত্তোলন কন্ট্রোল করা।
৪. সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিবিউশন লাইন মেরামত করা।
৫. সরবরাহ ডিসেনট্রালাইজেশন করা
শরীর স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে উন্নয়ন উন্নয়ন চিৎকার করে কি লাভ হবে? ঢাকা সহ বড় বড় শহরগুলোর প্রান বাঁচাতে এখনই এগিয়ে আসতে হবে সাংবাদিক, রাজনীতিবীদ, ছাত্র শিক্ষক সহ সচেতন সকল নাগরিককে।
লিংকন
পানি গবেষক
টোকিও জাপান