মুহাম্মদ নূরে আলম:
কাল থেকে শুরু হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার শতবছর এর শিক্ষার্থী হবে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা। গত শিক্ষাবর্ষ (২০২০-২১) পর্যন্ত ৭ হাজার ১২৫ শিক্ষার্থী স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তবে এবছর ১ হাজার ৯০ আসন কমিয়ে আসনসংখ্যা ৬ হাজার ৩৫ করা হয়েছে। এর মধ্যে ক ইউনিটে ১ হাজার ৮৫১, খ ইউনিটে ১ হাজার ৭৮৮, গ ইউনিটে ৯৩০, ঘ ইউনিটে ১ হাজার ৩৩৬ এবং চ ইউনিটে ১৩০টি আসন রয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাধান্য পাচ্ছে, বলা হচ্ছে এখানকার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালযের লাইব্রেরীতে স্থান দখল করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বই পড়ে। কেউ প্রস্তাব করেছেন এখানে ‘বিসিএস’ নামে একটি বিষয় চালু করতে, যাতে বিসিএস পরীক্ষার বিষয়গুলো এখানে পড়ে সরাসরি চাকুরীতে প্রবেশ করা যায়। অন্যান্য বিষয় পড়ে আবার বিসিএস পরীক্ষার জন্য বিশেষ যে প্রস্তুতি নিতে যাতে শ্রম ও সময় নষ্ট না হয়, এজন্য তাদের এই পরামর্শ। এক্ষেত্রে কয়েক ধাপ এগিয়ে শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়’নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রস্তাব করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য অন্য বিষয় নিয়ে ভেবেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির দিকে তাকালে মনে হবে, বাংলাদেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একই শিরোনামে তিনটি বিভাগ থেকে ডিগ্রী দেওয়া হচ্ছে। সরকারের ব্যাপক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (CDMP) সমর্থিত, সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ইনস্টিটিউট অফ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটিস স্টাডিজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন সব ধরণের ডিগ্রী দিচ্ছে বিভাগটি।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ২০১০ সাল থেকে দুই মেয়াদী মাস্টাস অব সাইন্স ইন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট (MSDM) ডিগ্রী প্রদান করছে। এরই মধ্যে, ২০১২ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালকে (বর্তমান উপ-উপাচার্য) চেয়ারম্যান করে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষ এক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছে। তাই সময়ের সাথে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমেছে। সারা বিশ্বে বরং বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। বরঞ্চ বিদেশীদেরকে আমরা শেখাতে পারি। অথচ এসব বিভাগে কোন বিদেশী শিক্ষার্থী নেই। তাহলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিক্ষার কেন এতো আয়োজন? বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা কমানো হলেও একই বিষয়ে তিনটি অনুষদ থেকে ডিগ্রী প্রদানের বিষয়টি বাদ দিয়ে গেছেন।
শিক্ষাও উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন হলেও আমাদের এখনকার শিক্ষার উদ্দেশ্য একটাই চাকুরী/ টাকার মালিক হওয়া। আর বর্তমান চাকুরী কাঠামো অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যে কোন চাকুরী ( ক্যাডার/নন-ক্যাডার) পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম বিসিএস পরীক্ষা। সুতরাং, ভাল চাকুরীর জন্য বিসিএস পরীক্ষায় বসা ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই। তাই এখনকার শিক্ষার্থীদের ধ্যান ও জ্ঞান শুধুই বিসিএস। এখানে অন্য চিন্তা অবান্তর। উচ্চশিক্ষাকে প্রয়োজন ও দক্ষতাভিত্তিক না করায় মূলত এই চিন্তা-চেতনার উদ্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশে যে পরিমাণে উচ্চ ডিগ্রীধারী আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি এবং অনাবশ্যক। বিশেষ দক্ষতা ছাড়াই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থীরা এসব ডিগ্রী নিয়েছেন। আর এই ডিগ্রীই তাদের জীবনে উন্নয়নের জন্য বড় বাধা। বড় বড় ডিগ্রীর কারণে তারা যেকোন কাজ করতে দ্বিধায় থাকেন। তারা চাকুরী এবং চাকুরী ছাড়া আর কিছুই বুঝেন না। অথচ দেশে-বিদেশে চাকুরীর জন্য যেসব যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রয়োজন তাদের শিক্ষা থেকে সেসব অর্জিত হয়নি। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও কম প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে আসন সংখ্যা কমানো উচিত। একইসঙ্গে দেশে-বিদেশে চাহিদাসম্পন্ন বিষয় চালু এবং আসন বৃদ্ধি প্রয়োজন।
কিন্তু বাজার উপযোগী শিক্ষাই কি সব? আমাদের প্রকৃত মানুষে পরিণত করতে এই শিক্ষা কী ভুমিকা রাখছে? বলা হয়, মানুষের বিত্ত পরিবর্তনের অন্যতম মাধ্যম শিক্ষা। একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সহজেই নিজের বিত্ত পরিবর্তন করে নিতে পারেন। শুধু নিজের কাছে নয়; সমাজে, রাষ্ট্রে নিজের অবস্থান পরিবর্তন বা জাত পরিবর্তনের সুযোগ করে দিয়েছে এই শিক্ষা। কিন্তু শিক্ষা যে আমাদের চিত্তের কোন পরিবর্তন পারেনি বা করতে ব্যর্থ তার নজির অসংখ্য আমাদের সামনে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটনাসমূহ এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সহজভাবে বলতে গেলে এই দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজরাই শিক্ষিত। বরঞ্চ শিক্ষা তাদেরকে আরো বেশি দুর্নীতি করতে শিখিয়েছে। মানবিকতা পরিস্ফুট করতে পারেনি এই আমাদের কথিত শিক্ষা ব্যবস্থা। মানবিক মানুষের খুবই অভার এই সমাজে।
উচ্চশিক্ষাকে প্রয়োজন ও দক্ষতাভিত্তিক করার পাশাপাশি এই শিক্ষা যেন শিক্ষার্থীদের শুধু বিত্ত নয়, চিত্তেরও বিকাশ ঘটাতে পারে , সেদিকেও নীতি নির্ধারকদের নজর দেওয়ার দরকার।
লেখকঃ মুহাম্মদ নূরে আলম,
সাংবাদিক ও খন্ডকালীন শিক্ষক, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়।